চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে এক চুমুক দিয়েছি কি, চার দিক থেকে দুপ্ দুপ দুপ্ দুপ শব্দ। ও কী রে বাবা, কামান-টামান কে ছুঁড়ছে, বোমা নাকি! না বাজি পোড়াচ্ছে কেউ। হাতি খেপল না তো?
ওমা, আবার দুলছে যে দেখি সব—পেয়ালা হাতে যে যার ডাইনে-বাঁয়ে দুলছে, প্যাণ্ডেল দুলছে। বহরমপুরের বৈকুণ্ঠবাবু—তিনি ছিলেন খুব গল্পে’, অতি চমৎকার মানুষ—তাড়াতাড়ি তিনি প্যাণ্ডেলের দড়ি দু হাতে দুটো ধরে ফেললেন। দড়ি ধরে তিনিও দুলছেন। কী হল, চার দিকে হরিবোল হরিবোল শব্দ। ভূমিকম্প হচ্ছে। যে যেখানে ছিল ছুটে বাইরে এল, হুলুস্থুলু ব্যাপার—শাঁখ-ঘণ্টা আর হরিবোল হরিবোল ধ্বনিতে একটা কোলাহল বাধল, সেই শুনে বুক দমে গেল। কাঁপুনি আর থামে না, থেকে থেকে কাঁপছেই কেবল।
কিছুক্ষণ কাটল এমনি। এবারে সব বাড়ি যেতে হবে। রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ একটা চওড়া ফাটল। এই বারান্দাটার মতো চওড়া যেন একটা খাল চলে গেছে। অনেকে লাফিয়ে লাফিয়ে পার হলেন, আমি আর লাফিয়ে যেতে সাহস পাই নে। ফাটলের ভিতর থেকে তখনো গরম ধোঁয়া উঠছে। ভয় হয় যদি পড়ে যাই কোথায় যে গিয়ে ঠেকব কে জানে। সবাই মিলে ধরাধরি করে কোনো রকমে তো ও পারে টেনে তুললে আমাকে। এগোচ্ছি আস্তে আস্তে। আশু চৌধুরী ছিলেন আমাদের দলেরই লোক, বড়ো নার্ভাস, তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হাত-পা নেড়ে বললেন, ওদিকে যাচ্ছ কোথায়। টেরিবল্ বিজনেস, একেবারে দ’ পড়েছে সামনে।
আমি বললুম, দ’ কী।
তিনি বললেন, আমি দেখে এলুম নদী উপছে এগিয়ে আসছে।
আমি বললুম, দূর হোকগে ছাই! ভাবলুম কাজ নেই বাড়ি গিয়ে, চলো সব রেল-লাইনের দিকে, উঁচু আছে, ডুববে না জলে।
চলতে চলতে এই-সব বলাবলি করছি, এমন সময় লোকজন এসে খবর দিলে, চলুন রাজবাড়ির দিকে, ভয় নেই কিছু।
রাস্তায় আসতে আসতে দেখি কত বাড়িঘর ভেঙে ধূলিসাৎ হয়েছে। পুকুরপাড়ে বড়ো সুন্দর পুরোনো একটি মন্দির ছিল, কী সুন্দর কারুকাজ-করা। নাটোরের বড়ো শখ ছিল সেই মন্দিরটির একটি স্কেচ করে দিই; বলেছিলেন, অবনদা, এটা তোমাকে করে দিতেই হবে। আমি বলেছিলুম, নিশ্চয়ই, আজ বিকেলেই এই মন্দিরটির একটি স্কেচ করব। পথে দেখি সেই মন্দিরটির কেবল চুড়োটুকু ঠিক আছে, আর বাদবাকি সব গুঁড়িয়ে গেছে। মন্দিরটির উপরে চুড়োটুকু ডাঁটভাঙা কারুকার্য-করা রাজছত্রের মতো পড়ে আছে। নাটোরের বৈঠকখানা ভেঙে একেবারে তচ্নচ্। আহা, এমন সুন্দর করে সাজিয়েছিলেন তিনি। ঝাড়লণ্ঠন ফুলদানি সব গুঁড়ো গুঁড়ো ঘরময় ছড়াছড়ি। রাজবাড়ির ভিতরে খবর গেছে আমরা সব প্যাণ্ডেল চাপা পড়েছি, রানীমা কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছেন। তাঁকে অনেক বুঝিয়ে ঠাণ্ডা করা হয় যে আমরা কেউ চাপা পড়ি নি, সবাই সশরীরে বেঁচে আছি।
কোথায় গেল গরম গরম সন্দেশ খাওয়া। সেই রাত্রে বাঈজীর নাচ হবার কথা ছিল। নাটোর বলেছিলেন এখানে নাচ দেখে যেতে হবে—সব জোগাড়যন্তোর করা হয়েছিল। চুলোয় যাকগে নাচ, বৈঠকখানা তো ভেঙে চুরমার।
চার দিকে যেন একটা প্রলয়কাণ্ড হয়ে গেছে। সব উৎসাহ আমাদের কোথায় চলে গেল। কলকাতায় মা আর সবাই আমাদের জন্য ভেবে অস্থির, আমরাও করি তাঁদের জন্য ভাবনা। অথচ চলে আসবার উপায় নেই; রেল-লাইন ভেঙে গেছে, নদীর উপরের ব্রিজ ঝুর্ঝুরে অবস্থায়, টেলিগ্রাফের লাইন নষ্ট। তবু কী ভাগ্যিস আমাদের একটি তার কী করে মার কাছে এসে পৌঁচেছিল, ‘আমরা সব ভালো’। আমরাও তাদের একটিমাত্র তার পেলুম যে তাঁরাও সবাই ভালো আছেন। আর-কারো কোনো খবরাখবর করবার বা নেবার উপায় নেই। কী করি, চলে আসবার যখন উপায় নেই থাকতেই হচ্ছে ওখানে। নাটােরকে বললুম, কিন্তু তোমার বৈঠকখানা-ঘরে আর ঢুকছি না। রবিকাকারও দেখি তাই মত, পাকা ছাদের নীচে ঘুমোবার পক্ষপাতী নন। তখনো পাঁচ মিনিট বাদে বাদে সব কেঁপে উঠছে। কখন বাড়িঘর ভেঙে পড়ে ঘাড়ে, মরি আর কি চাপা পড়ে! বললুম, অন্য কোথাও বাইরে জায়গা করে।
নাটোরের একটা কাছারি বাংলো ছিল একটু দূরে, বেশ বড়োই। ভিতরে ঢুকে আগে দেখলুম ছাদটা কিসের—দেখি, না, ভয়ের কিছু নেই, ছাদটি খড়ের, নীচে ক্যান্ভাসের চাঁদোয়া দেওয়া। ভাবলুম যদি চাপা পড়ি, না-হয় ক্যান্ভাস ছিঁড়েফুঁড়ে বের হতে পারব কোনোরকমে। ঠিক হল সেখানেই থাকব, ব্যবস্থাও হয়ে গেল। খাবার জায়গা হল গাড়িবারান্দার নীচে। তেমন কিছু হয় তো চট্ করে বাগানে বেরিয়ে পড়া যাবে সহজেই।
মেজোজ্যাঠামশায় অদ্ভুত লোক। তিনি কিছুতেই মানলেন না; তিনি বললেম, আমি ঐ আমার ঘরেতেই থাকব, আমি কোথাও যাব না। নাটাের পড়লেন মহা বিপদে। এখন কিছু একটা ঘটে গেলে উপায় কী। মেজোজ্যাঠামশায় কিছুতেই কিছু শুনলেন না; শেষে কী করা যায়, নাটাের হুকুম দিলেন ছ-সাতজন লোক দিনরাত ওঁর ঘরের সামনে পাহারা দেবে। তেমন তেমন দেখলে যেমন করে হোক মেজোজ্যাঠামশায়কে পাঁজাকোলা করে বাইরে আনবে। নয় তো তাদের আর ঘাড়ে মাথা থাকবে না।
চলতে লাগল সেই দিনটা এমনি করেই। এখন, মুশকিল হচ্ছে চানের ঘর নিয়ে। চানের ঘরে ঢুকে লোকে চান করছে এমন সময়ে হয়তো আবার কাঁপুনি শুরু হল; তাড়াতাড়ি গামছা পরে যে যে-অবস্থায় আছে বেরিয়ে আসেন। এ এক বিভ্ৰাট। চানের ঘরে কেউ আর ঢুকতে পারেন না।