তা, কর্তাদিদিমা জগদীশমামাকে অমনি তাড়া লাগালেন, যা যা, ও তোরা বুঝবি নে। শকুনি কোথায়, ও তো শুকপক্ষী।
সেই খাট বহুকাল অবধি ছিল, দীপুদাও সেই খাটে ঘুমিয়েছেন। এখন কোথায় যে আছে সেই খাটটি, আগে জানলে দু-একটা পরী পায়ার উপর থেকে খুলে আনতুম।
সাত সাত ছেলে কর্তাদিদিমার; তাঁকে বলা হত রত্নগর্ভা। কর্তাদিদিমার সব ছেলেরাই কী সুন্দর আর কী রঙ। তাঁদের মধ্যে রবিকাকাই হচ্ছেন কালো। কর্তাদিদিমা খুব কষে তাঁকে রূপটান সর ময়দা মাখাতেন। সে কথা রবিকাকাও লিখেছেন তাঁর ছেলেবেলায়। কর্তাদিদিমা বলতেন, সব ছেলেদের মধ্যে রবিই আমার কালো।
সেই কালো ছেলে দেখো জগৎ আলো করে বসে আছেন।
কর্তাদিদিমা আঙুল মটকে মারা যান। বড়োপিসিমার ছোটাে মেয়ে, সে তখন বাচ্ছা, কর্তাদিদিমার আঙুল টিপে দিতে দিতে কেমন করে মটকে যায়। সে আর সারে না, আঙুলে আঙুলহাড়া হয়ে পেকে ফুলে উঠল। জ্বর হতে লাগল। কর্তাদিদিমা যান-যান অবস্থা। কর্তাদাদামশায় ছিলেন বাইরে—কর্তাদিদিমা বলতেন, তোরা ভাবিস নে, আমি কর্তার পায়ের ধুলো মাথায় না নিয়ে মরব না, তোরা নিশ্চিন্ত থাক্।
কর্তাদাদামশায় তখন ডালহৌসি পাহাড়ে, খুব সম্ভব রবিকাকাও সে সময়ে ছিলেন তাঁর সঙ্গে। তখনকার দিনে খবরাখবর করতে অনেক সময় লাগত। একদিন তো কর্তাদিদিমার অবস্থা খুবই খারাপ, বাড়ির সবাই ভাবলে আর বুঝি দেখা হল না কর্তাদাদামশায়ের সঙ্গে। অবস্থা ক্রমশই খারাপের দিকে যাচ্ছে, এমন সময়ে কর্তাদাদামশায় এসে উপস্থিত। খবর শুনে সোজা কর্তাদিদিমার ঘরে গিয়ে পাশে দাঁড়ালেন, কর্তাদিদিমা হাত বাড়িয়ে তার পায়ের ধুলো মাথায় নিলেন। ব্যস, আস্তে আস্তে সব শেষ।
কর্তাদাদামশায় বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। বাড়ির ছেলেরা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার যা করবার সব করলেন। সেই দেখেছি দানসাগর শ্রাদ্ধ, রুপোর বাসনে বাড়ি ছেয়ে গিয়েছিল। বাড়ির কুলীন জামাইদের কুলীন-বিদেয় করা হয়। ছোটােপিসেমশায় বড়োপিসেমশায় কুলীন ছিলেন, বড়ো বড়ো রুপোর ঘড়া দান পেলেন। কাউকে শাল-দোশালা দেওয়া হল। সে এক বিরাট ব্যাপার।
আর-এক দিদিমা ছিলেন আমাদের, কয়লাহাটার রাজা রমানাথ ঠাকুরের পুত্রবধু, নৃপেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী। রাজা রমানাথ ছিলেন দ্বারকানাথের বৈমাত্রেয় ভাই। সে দিদিমাও খুব বুড়ি ছিলেন। আমরা তাঁর সঙ্গে খুব গল্পগুজব করতুম, তিনিও আমাদের দেখা-দিদিমা, তিনিও যশোরের মেয়ে। আমি যখন বড়ো হয়েছি মাঝে মাঝে ডেকে পাঠাতেন আমাকে; বলতেন, অবনকে আসতে বোলো, গল্প করা যাবে। সে দিদিমার সঙ্গে আমার খুব জমত। আমি যে স্ত্রী-আচার সম্বন্ধে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলুম তাতে দরকারি নোটগুলি সব ঐ দিদিমার কাছ থেকে পাওয়া। আমার তখন বিয়ে হয়েছে। দিদিমা বউ দেখে খুশি; বলতেন, বেশ, খাসা বউ হয়েছে, দেখি কী গয়না-টয়না দিয়েছে। ব’লে নেড়ে-চেড়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতেন। বলতেন, বেশ দিয়েছে, কিন্তু তোরা আজকাল এই রকম দেখা-গয়না পরিস কেন।
আমি বলতুম, সে আবার কী রকম।
দিদিমা বলতেন, আমাদের কালে এ রকম ছিল না, আমাদের দস্তুর ছিল গয়নার উপরে একটি মসলিনের পটি বাঁধা থাকত।
আমি বলতুম, সে কি গয়না ময়লা হয়ে যাবে বলে।
তিনি বলতেন, না, ঘরে আমরা গয়না এমনিই পরতুম, কিন্তু বাইরে কোথাও যেতে হলেই হাতের চুড়ি-বালা-বাজুর উপরে ভালো করে মসলিনের টুকরো দিয়ে বেঁধে দেওয়াই দস্তুর ছিল তখনকার দিনে। ঐ মসলিনের ভিতর দিয়েই গয়নাগুলো একটু একটু ঝক্ঝক্ করতে থাকত। দেখা-গয়না তো পরে বাঈজী নটীরা, তারা নাচতে নাচতে হাত নেড়েচেড়ে গয়নার ঝক্মকানি লোককে দেখায়। খোলা-গয়নার ঝক্মকানি দেখানো, ও-সব হচ্ছে ছোটোলোকি ব্যাপার।
খুব পুরোনো মোগল ছবিতে আমারও মনে হয় ও রকম পাতলা রঙিন কাপড় দিয়ে হাতে বাজু বাঁধা দেখেছি। ঐ ছিল তখনকার দিনের দস্তুর। এই দেখা-গয়নার গল্প আমি আর কারো কাছে শুনি নি, ঐ দিদিমার কাছেই শুনেছি।
তখনকার মেয়েদের সাজসজ্জার আর-একটা গল্প বলি।
ছোটোদাদামশায়ের আর বিয়ে হয় না। কর্তা দ্বারকানাথ ষোলো বছর বয়সে ছোটোদাদামশায়কে বিলেত নিয়ে যান, সেখানেই তাঁর শিক্ষাদীক্ষা হয়। দ্বারকানাথের ছেলে, বড়ো বড়ো সাহেবের বাড়িতে থেকে একেবারে ঐদেশী কায়দাকানুনে দোরস্ত হয়ে উঠলেন। আর, কী সম্মান সেখানে তাঁর। তিনি ফিরে আসছেন দেশে। ছোটোদাদামশায় সাহেব হয়ে ফিরে আসছেন—কী ভাবে জাহাজ থেকে নামেন সাহেবি সুট প’রে, বন্ধুবান্ধব সবাই গেছেন গঙ্গার ঘাটে তাই দেখতে। তখনকার সাহেবি সাজ জান তো? সে এই রকম ছিল না, সে একটা রাজবেশ—ছবিতে দেখো। জাহাজ তখন লাগত খিদিরপুরের দিকে, সেখান থেকে পানসি করে আসতে হত। সবাই উৎসুক— নগেন্দ্রনাথ কী পোশাকে নামেন। তখনকার দিনের বিলেত-ফেরত, সে এক ব্যাপার। জাহাজঘাটায় ভিড় জমে গেছে।
ধুতি পাঞ্জাবি চাদর গায়ে, পায়ে জরির লপেটা, ছোটােদাদামশায় জাহাজ থেকে নামলেন। সবাই তো অবাক।
ছোটোদাদামশায় তো এলেন। সবাই বিয়ের জন্য চেষ্টাচরিত্তির করছেন, উনি আর রাজি হন না কিছুতেই বিয়ে করতে। তখন সবেমাত্র বিলেত থেকে এসেছেন, ওখানকার মোহ কাটে নি। আমাদের দিদিমাকে বলতেন, বউঠান, ঐ তো একরত্তি মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবে তোমরা, আর আমার তাকে পালতে হবে, ও-সব আমার দ্বারা হবে না। সবাই বোঝাতে লাগলেন, তিনি আর ঘাড় পাতেন না। শেষে দিদিমা খুব বোঝাতে লাগলেন; বললেন, ঠাকুরপো, সে আমারই বোন, আমি তার দেখাশোনা সব করব—তোমার কিছুটি ভাবতে হবে না, তুমি শুধু বিয়েটুকু করে ফেলো কোনো রকমে।