আমরা সবাই বারান্দা থেকে দেখছি। দীপুদা আগেই সরে পড়েছিলেন। তিনি বললেন, আমি আর দেখতে পারব না। কর্তাদাদামশায় ‘বাতাস বাতাস’ বলতে বলতেই এক সময়ে বলে উঠলেন, আমি বাড়ি যাব। যেই-না এ কথা বলা, বড়োপিসিমার দু চোখ বেয়ে জল গড়াতে লাগল। বুঝি-বা এইবারে সত্যিই তাঁর বাড়ি যাবার সময় হয়ে এল। থেকে থেকে কর্তাদাদামশায় ঐ কথাই বলতে লাগলেন। সে কী সুর, যেন মার কাছে ছেলে আবদার করছে ‘আমি বাড়ি যাব’। বেলা তখন প্রায় দ্বিপ্রহর; ঘড়িতে টং টং করে ঠিক যখন বারোটা বাজল সঙ্গে সঙ্গে কর্তাদাদামশায়ের শেষ নিশ্বাস পড়ল। যেন সত্যিই মা এসে তাকে তুলে নিয়ে গেলেন। একটু শ্বাসকষ্ট না, একটু বিকৃতি না, দক্ষিণ মুখে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যেন ঘুমিয়ে পড়লেন।
খবর পেয়ে দেখতে দেখতে শহরসুদ্ধ লোক জড়ো হল। শ্মশানে নিয়ে যাবার তোড়জোড় হতে লাগল। এই-সব হতে হতে তিনটে বাজল। ততক্ষণে কর্তাদাদামশায়ের দেহ হয়ে গেছে যেন চন্দনকাঠের সার। তখন ঐ একটিই পুরোনো ঘোরানো সিঁড়ি ছিল উপরে উঠবার। আমরা বাড়ির ছেলেরা সবাই মিলে তাঁর দেহ ধরাধরি করে তো অতিকষ্টে সেই ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামালুম। সাদা ফুলে ছেয়ে গিয়েছিল চার দিক। সেই ফুলে সাজিয়ে আমরা তাঁর দেহ নিয়ে চললুম শ্মশানে, রাস্তায় ফুল আবীর ছড়াতে ছড়াতে। রাস্তার দু ধারে লোক ভেঙে পড়েছিল। আস্তে আস্তে চলতে লাগলুম। দীপুদা ঠিক করলেন, নিমতলার শ্মশানঘাট ছাড়িয়ে খোলা জায়গায় গঙ্গার পাড়ে কর্তাদাদামশায়ের দেহ দাহ করা হবে। এ পারে চিতে সাজানো হল চন্দন কাঠ দিয়ে, ও পারে সূর্যাস্ত, আকাশ সেদিন কী রকম লাল হয়েছিল—যেন সিঁদুরগোলা।
রবিকাকারা মুখাগ্নি করলেন, চিতে জ্বলে উঠল। একটু ধোঁয়া না, কিছু না, পরিষ্কার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল, বাতাসে চন্দনের সৌরভ ছড়িয়ে গেল। কী বলব তোমাকে, সেই আগুনের ভিতর দিয়ে অনেকক্ষণ অবধি কৰ্তাদাদামশায়ের চেহারা, লম্বা শুয়ে আছেন, ছায়ার মতো দেখা যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন লক্লকে আগুনের শিখাগুলি তাকে স্পর্শ করতে ভয় পাচ্ছে। তাঁর চার দিকে সেই আগুনের শিখা যেন ঘুরে ঘুরে নেচে বেড়াতে লাগল। দেখতে দেখতে সেই শিখা উপরে উঠতে উঠতে এক সময়ে দপ্ করে নিবে গেল, এক নিশ্বাসে সবকিছু মুছে নিলে। ও পারে সূর্য তখন অস্ত গেল।
০৪. সেকালের কর্তাদের গল্প শুনলে
সেকালের কর্তাদের গল্প শুনলে, এবারে দিদিমাদের গল্প কিছু শোনো।
আমার নিজের দিদিমা, গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবার, নাম যোগমায়া, তাঁকে আমি চোখে দেখি নি। তাঁর গল্প শুনেছি—মা, বড়োপিসিমা, ছোটােপিসিমা—কাদম্বিনী, কুমুদিনীর কাছে। বড়োপিসিমা বলতেন, আমার মার মতো অমন রূপসী সচরাচর আর দেখা যায় না। কী রঙ, যাকে বলে সোনার বর্ণ। মা জল খেতেন, গলা দিয়ে জল নামত স্পষ্ট যেন দেখা যেত; পাশ দিয়ে চলে গেলে গা দিয়ে যেন পদ্মগন্ধ ছড়াত। দিদিমার কিছু গয়না আমার কাছে আছে এখনো, সিঁথি, হীরে-মুক্তো-দেওয়া কানঝাপটা৷ মা পেয়েছিলেন দিদিমার কাছ থেকে। দিদিমার একটি সাতনরী হার ছিল, কী সুন্দর, দুগ্গো-প্রতিমার গলায় যেমন থাকে সেই ধরনের। মা সেটিকে মাঝে মাঝে সিন্দুক থেকে বের করে আমাদের দেখাতেন; বলতেন, দেখ্, আমার শাশুড়ির খোস্বো শুঁকে দেখ।
আমরা হাতে নিয়ে শুঁকে শুঁকে দেখতুম, সত্যিই আতরচন্দনের এমন একটা সুগন্ধ ছিল তাতে। তখনো খোস্বো ভুরভুর করছে, সাতনরী হারের সঙ্গে যেন মিশে আছে। সেকালে আতর মাখবার খুব রেওয়াজ ছিল, আর তেমনিই সব আতর। কতকাল তো দিদিমা মারা গেছেন, আমরা তখনো হই নি, এতকাল বাদে তখনো দিদিমায়ের খোস্বো তাঁর হারের সোনার ফুলের মধ্যে পেতুম। সেই হারটি মা সুনয়নীকে দিয়েছিলেন। ছোটোপিসিমার বিয়ে দিয়েই দিদিম মারা যান।
একবার দিদিমার অসুখ হয়। তখন দু-জন ফ্যামিলি ডাক্তার ছিলেন আমাদের। একজন বাঙালি, নামজাদা ডি. গুপ্ত; আর একজন ইংরেজ, বেলী সাহেব। এই দু-জন বরাদ্দ ছিল, বাড়িতে কারো অসুখ-বিসুখ হলে তাঁরাই চিকিৎসাদি করতেন। বেলী সাহেবের তখনকার দিনে ডাক্তার হিসেবে খুব নামডাক ছিল, তার উপরে দ্বারকানাথ ঠাকুরমশায়ের ফ্যামিলি ডাক্তার তিনি। রাস্তা দিয়ে বেলী সাহেব বের হলেই দু পাশে লোক দাঁড়িয়ে যেত ওষুধের জন্য। তাঁর গাড়িতে সব সময় থাকত একটা ওষুধের বাক্স, গরিবদের তিনি অমনিই দেখতেন, ওষুধ বিতরণ করতে করতে রাস্তা চলতেন। তা দিদিমার অসুখ, বেলী সাহেব এলেন, সঙ্গে এলেন ডি. গুপ্তও, দিদিমার অসুখটা বুঝিয়ে দেবার জন্য।
দিদিমা বিছানায় শুয়ে শুয়েই কাছে আনিয়ে দাসীকে দিয়ে মাছ তরকারি কাটিয়ে কুটিয়ে দেওয়াতেন, ছেলেদের জন্য রান্না হবে। বেলী সাহেব দাসীকে বাংলায় হাত ধোবার জন্য একটা জলের ঘটি আনতে বললেন। দাসী বেলী সাহেবের আড়বাংলাতে ঘটিকে শুনেছে বঁটি। সে তাড়াতাড়ি মাছকাটা বঁটি নিয়ে এসে হাজির ৷ বেলী সাহেব চেচিয়ে উঠলেন, ও মা গো, বঁটি নিয়ে আপনার দাসী এল, আমার গলা কাটবে নাকি!
দাসী তে এক ছুটে পলায়ন, আর বেলী সাহেবের হো-হো করে হাসি। এমনিই তিনি ঘরোয়া ছিলেন।
বেলী সাহেব দিদিমাকে তো ভালো করে পরীক্ষা করলেন। ডি. গুপ্তকে বললেন দিদিমাকে বুঝিয়ে দেবার জন্য যে, তিনি একটু এনিমিক হয়েছেন। বললেন, দোওয়ারীবাবু, মাকে তাঁর অসুখটা বাংলায় ভালো করে বুঝিয়ে দিন।