কর্তাদাদামশায় লোকদের খাওয়াতে খুব ভালোবাসতেন, আর বিশেষ করে তার ঝোঁক ছিল পায়েসের উপর। ছোটোপিসেমশায়ের কাছে গল্প শুনেছি, তিনি বলতেন কর্তামশায়ের সামনে বসে খাওয়া সে এক বিপদ। প্রথমত কিছু তো ফেলবার জো নেই—অপৰ্যাপ্ত পরিবেশন করা হবে, সব তো পরিষ্কার করে খেতে হবে। সে তো কোনোরকমে সারা হত, কিন্তু তার পরে যখন পায়েস আসত তখনই বিপদ। পায়েস বাদ দিলে চলবে না, পায়েস খেতেই হবে, নইলে খাওয়া শেষ হল কী। এই পায়েসেরও আবার একটা মজার গল্প আছে, এও আমার ছোটােপিসেমশায়ের কাছে শোনা।
প্রথম দলে যাঁরা ব্রাহ্ম হয়েছিলেন, দীক্ষা নেওয়ার পর তাদের সবাইকে কর্তাদাদামশায় ওঁ-লেখা মাঝে-রুবি-দেওয়া একটি করে আংটি দিয়েছিলেন। ছোটোপিসেমশায় ছিলেন প্রথম দলের। তিনি প্রায়ই আমাদের সে গল্প বলে বলতেন, জানিস আমি আংটি-পরা ব্রাহ্ম। কর্তাদাদামশায় তখনকার দিনে নিয়ম করে এই দলকে নিয়ে বাগানে যেতেন। সেখানে সকালে স্নান করে উপাসনাদি হত। বামুন-চাকর সঙ্গে যেত, গাছতলায় উনুন খুঁড়ে রান্নাবান্না হত। কেউ কেউ শখ করে নিজেরাও রাঁধতেন। এইভাবে সারা দিন কাটিয়ে আসতেন। এ একেবারে নিয়ম-বাঁধা ছিল। প্রায়ই তাঁরা আমাদের চাঁপদানির বাগানে যেতেন। সেবারেও কর্তাদাদামশায় দলবল নিয়ে গেছেন চাঁপদানির বাগানে। সকালে উপাসনাদি হবার পর রান্নার আয়োজন চলছে। কর্তাদাদামশায় বললেন, পায়েসটা আমি রান্না করব; আমি পায়সান্ন পরিবেশন করে খাওয়াব সবাইকে।
ঘড়া ঘড়া দুধ, থালাভরা মিষ্টি এল। কর্তাদাদা তো পায়েস রান্না করলেন। সবাই খেতে বসেছেন, সব খাওয়া হয়ে গেছে, পায়েস পরিবেশন করা হল। কর্তাদাদামশায়কেও পায়েস দেওয়া হয়েছে। এখন, সবাই একটু পায়েস মুখে দিয়েই হাত গোটালেন, মুখে আর তেমন তোলেন না। কর্তাদাদামশায় সামনে, কেউ কিছু বলতেও পারেন না। মাঝে মাঝে পায়েস একটু একটু মুখেও তুলতে হয়। কর্তাদাদামশায় জিজ্ঞেস করলেন, কী, কেমন হয়েছে পায়েস, ভালো হয়েছে তো?
সবাই ঘাড় নাড়লেন, পায়েস চমৎকার হয়েছে।
তাঁদেরই মধ্যে কে একজন বলে ফেললেন, আজ্ঞে, ভালোই হয়েছে, তবে একটু ধোঁয়ার গন্ধ।
কর্তাদাদামশায় বললেন, ধোঁয়ার গন্ধ হয়েছে তো? ঐটিই আমি চাইছিলুম, আমি আবার পায়েসে একটু ধোঁয়াটে গন্ধ পছন্দ করি কিনা।
পায়েসটা কিন্তু আসলে রান্না করবার সময় ধরে গিয়েছিল। কর্তাদাদামশায় এই রকম তামাশাও করতেন মাঝে মাঝে। রবিকাকারও এই রকম তামাশা করবার অনেক গল্প আছে।
কর্তাদাদামশায় নিজেও দুধ ক্ষীর পায়েস এই-সব খেতে বরাবরই ভালোবাসতেন। শেষ দিকেও দেখেছি, বড়ো একটা কাঁচের বাটি ছিল সেটা ভরতি তিনি ঘন জ্বাল-দেওয়া দুধ খেতেন রোজ। একদিন কী করে বাটিটা ভেঙে যায়। বড়োপিসিমা তখন তাঁর সেবা করতেন, তিনি বাজার থেকে যত রকমের কাঁচের বাটিই আনান, কর্তাদাদামশায়ের পছন্দ আর হয় না। ঠিক তেমনটি আর পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। কোনোটা হয় বড়ো, কোনোটা হয় ছোটো। ঠিক সেই মাপের চাই। আবার পাতলা কাঁচের হলেও চলবে না। একবার কর্তাদাদামশায়ের শরবত খাবার কাঁচের গ্লাসটি ভেঙে যায়। দীপুদা শখ করে সাহেবি দোকান অস্লার কোম্পানি থেকে পাতলা কাঁচের গ্লাস এক ডজন কিনে আনলেন কর্তাদাদামশায়ের শরবত খাবার জন্য। কর্তাদাদামশায় বললেন, এ কী গ্লাস! শরবত খাবার সময়ে আমার দাঁত লেগেই যে ভেঙে যাবে। সে গ্লাস চলল না—দীপুদাই বকশিশ পেলেন। তার পর বোম্বাই থেকে চার দিকে গোল-গোল পল-তোলা পুরু বোম্বাই গ্লাস এল, তবে কর্তাদাদামশায় তাতে শরবত খেয়ে খুশি। বড়োপিসিমা একদিন আমাকে বললেন, অবন, তুই তো নানা জায়গায় ঘুরিস, দেখিস তো, কোথাও যদি ওরকম একটি বাটি পাস বাবামশায়ের দুধ খাবার জন্য। একদিন গেলুম আমার জানাশোনা কয়েকটি লোক নিয়ে মুর্গিহাটায়। ভাবলুম বিলিতি জিনিস তো কর্তাদাদামশায়ের পছন্দ হবে না, দেশীও তেমন ভালো নেই— মুর্গিহাটায় গিয়ে খোঁজ করলুম পার্শিয়ান কাঁচের বাটি আছে কি না। ভাবলুম, ওরকম জিনিস কর্তাদাদামশায়ের পছন্দ হতে পারে। বেশ নতুন ধরনের হবে। সেখানকার লোকেরা বললে, আমাদের কাছে তো সে-সব জিনিস থাকে না। তারা আমাকে নিয়ে গেল চীনেবাজারের গলিতে এক নাখোদা সওদাগরের বাড়িতে। গলির মধ্যে বাড়ি বুঝতেই পার কেমন, ঢুকলুম তার ঘরে। ঢুকে মনে হল যেন আরব্য উপন্যাসের সিন্ধবাদের ঘরে ঢুকলুম, এমনিভাবে ঘর সাজানো। ঘরজোড়া ফরাশ পাতা, ধব্ ধব্ করছে, চার দিকে রেলিং-দেওয়া চওড়া মঞ্চ, তাতে বসে হুঁকো খায়। গড়গড়া ও নানা রকমের টুকিটাকি জিনিস, খুব যে দামী কিছু তা নয়, কিন্তু কী সুন্দর ভাবে সাজানো সব। লোকটি আদর-অভ্যর্থনা করে ফরাশে নিয়ে বসালে, চা খাওয়ালে। চা-টা খাওয়ার পর তাকে বললুম, একটি বেলোয়ারি বড়ো বাটি কর্তার দুধ খাবার জন্য দিতে পার? সে বললে, আজকাল তো সে-সব পুরোনো জিনিস এ দিকে আসে না বড়ো, তবে আমার গুদোমঘরটা একবার দেখাতে পারি, যদি কিছু থাকে। গুদোমঘর খুলে দিলে, যেমন হয়ে থাকে গুদোমঘর, হরেক রকম জিনিসে ঠাসা—তার মধ্যে হঠাৎ নজরে পড়ল একটি বেশ বড়ো পার্শিয়ান ক্রিস্টেলের বাটি, সাদা ক্রিস্টেলের উপর গোলাপী ক্রিস্টেলের ফুলের নকশা। চমৎকার বাটিটা, ঠিক যেমনটি চেয়েছিলুম। তার আরো দুটাে ক্রিস্টেলের জিনিস ছিল, একটা হুঁকো আর একটা গোলাপপাশ, সবুজ রঙ নবদুর্বোর মতো, তার উপরে সোনালি কাজ করা। সব কয়টাই নিয়ে এলুম। ভাবলুম, কর্তাদাদামশায় আর এ দুটো দিয়ে কী করবেন—তাঁর বাটির কল্যাণে আমারও দুটো জিনিস পাওয়া হবে। বড়ো বাটিটি পিসিমার পছন্দ হল; বললেন, এইবার বোধ হয় ঠিক পছন্দ করবেন, কাল খবর পাবে। পরদিন তাই হল, বাটিটি পেয়ে কর্তাদাদামশায় খুব খুশি, আর বললেন—এ হুঁকো আর গোলাপপাশ আমার দরকার নেই, তুমিই নাও গে। বড়ো চমৎকার জিনিস দুটাে, অনেকদিন ছিল আমার কাছেই। তা, ঐ বাটিটিতে উনি শেষকাল পর্যন্ত রোজ দুধ খেতেন। তিনি আমাদের মতো বাটির কানা এক হাতে ধরে দুধ খেতেন না। বড়োপিসিমা দুধের বাটি নিয়ে এলেই অঞ্জলি পেতে দু হাতের মধ্যে বাটিটি নিয়ে মুখে তুলে দুগ্ধ পান করতেন। বাটির নীচে একটা ন্যাপকিন দেওয়া থাকত—যাতে হাতে গরম না লাগে। যখন মেয়ের কাছ থেকে অঞ্জলি পেতে বাটিটি নিতেন কী সুন্দর শোভা হত। তাঁর হাত দুখানিও ছিল বেশ বড়ো বড়ো; তাই হাতের মাপসই বাটি নইলে তার ভালো লাগত না। কর্তাদাদামশায়ের গোরু রোজ গুড় খেত। বড়োপিসিমার উপরেই এই ভার ছিল, রোজ তিনি গোরুকে গুড় খাওয়াতেন। গোরু গুড় খেলে কী হবে? গোরুর দুধ মিষ্টি হবে। দীপুদা বলতেন, দেখছিস কাণ্ড, আমরা গুড় খেতে পাই নে একটু লুচির সঙ্গে, আর কর্তাদাদামশায়ের গোরু দিব্যি কেমন রোজ গাদা গাদা গুড় খাচ্ছে। আমি নাতি হয়ে জন্মেও কিছুই করতে পারলুম না। দীপুদার কথা ছিল সব এমনিই, বেশ রসালো করে কথা বলতেন।