ব্যস! সেই থেকে শুরু হল রাষ্ট্রপতি ভবনের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তরুণ শিল্পীদের আত্মপ্রকাশ। অনেক শিল্পীর কথাই এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে কিন্তু বিশেষ করে মনে পড়ছে আজকের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্না ভারতনাট্যম শিল্পী শ্ৰীমতী যামিনী কৃষ্ণমূর্তির কথা।
বিশ-বাইশ বছর আগে কে চিনত যামিনী কৃষ্ণমূর্তিকে।
আমি যামিনীকে প্রথম দেখি উপরাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণণের বাড়িতে। আমি ঘরে ঢুকতেই যামিনীকে দেখিয়ে রাধাকৃষ্ণণ আমাকে বললেন, যামিনী ইজ এ ভেরি গুড ডালার। তোমাদের উইকলি কাগজে তো নানা রকমের লোকজনকে নিয়ে ফিচার লিখছ। হোয়াই নট রাইট অন যামিনী?
দু-একদিন পর আমি আমাদের পত্রিকার ফটোগ্রাফার সুদর্শন। খোসলকে নিয়ে এক সকালবেলায় হাজির হলাম যামিনীর আস্তানায়। কনট প্লেসে একটা দোকানের ওপরের একখানা ঘরে যামিনী তাঁর বাবা পণ্ডিত কৃষ্ণমূর্তি ও ছোট বোন যমুনাকে নিয়ে থাকে। বেশ মনে আছে ঘরের মধ্যে কোন আসবাবপত্র ছিল না। মেঝেতে সতরঞ্চি বিছিয়ে যমুনা আমাদের বসতে দিল। ঘরের পাশের একফালি বারান্দা থেকে ভারত নাট্যমের সাজে সেজে আসার পর যামিনীর নানা ভঙ্গিমায় ছবি তোলা হল ঘণ্টাখানেক ধরে। দু-এক সপ্তাহ পরেই যামিনীর দশ-বাবোখানা ছবি ছাপা হল আমাদের পত্রিকায়। পত্রিকাটি দেখে রাধাকৃষ্ণণ মহা খুশি হয়েছিলেন এবং যত দূর মনে পড়ে সেই প্রথম যামিনীর ছবি ছাপা হয়।
আজ থেকে ঠিক তেইশ বছর আগেকার ঘটনা। তারপর গঙ্গা যমুনা দিয়ে কত জল গড়িয়ে গেছে। নিত্যনতুন সম্মানের স্মৃতিতে যামিনী হয়তো সেদিনের কথা ভুলে গেছেন কিন্তু আমি ভুলিনি রাধাকৃষ্ণণ ওর জন্য কি করেছিলেন। জানি না যমুনা কোথায় আছে। যমুনাও খুব ভাল শিল্পী ছিল। বোধ হয় দিদির খ্যাতির পথে প্রতিদ্বন্দিনী না হবার জন্য যমুনা নাচ ছেড়ে দেয়। ওকে দেখলেই আমার অন্নপূর্ণাদেবীর কথা মনে হত। সেন্ট্রাল ভিস্তা এয়ারফোর্স মেসের সেই সুন্দর অফিসারটির সঙ্গেই বোধ হয় যমুনার বিয়ে হয়েছে।
সে যাই হোক মৌলানা আবুল কালাম আজাদের জন্যই যেমন ইন্দ্রানী রহমানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশে-বিদেশে, সেই রকম সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের জন্যই যামিনী কৃষ্ণমূর্তির খ্যাতি হয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস।
এই প্রসঙ্গে এক বাঙালী শিল্পীর কথা মনে পড়ছে। শিল্পী। হিসাবে রাধাকৃষ্ণণ তাঁকে খুবই পছন্দ করতেন এবং তাঁর জন্য কিছু করতে পারলে রাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণণ অত্যন্ত খুশি হতেন কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় শিল্পী তাঁকে সে সুযোগ দেননি।
.
সেটা ১৯৬৫ সাল। বছর খানেক আগে প্রধানমন্ত্রী নেহরু মারা গিয়েছেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী হলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। কংগ্রেস সভাপতি কামরাজ, সঞ্জীব রেড্ডি, অতুল্য ঘোষ, নিজলিঙ্গাপ্পা এবং আনো কয়েকজন দুরদর্শিতাহীন কংগ্রেস নেতারা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রচার শুরু করলেন–লালবাহাদুরের প্রধানমন্ত্রী হবার কোন মুরোদ নেই কিন্তু লোকটি মোটামুটি ভাবে জনপ্রিয় বলেই ওরা ওকে প্রধান মন্ত্রী করেছেন এই সর্তে যে ওদের পরামর্শ মতই উনি দেশ চালাবেন। এই সব প্রাদেশিক কংগ্রেসী জায়গীরদাররা দিল্লীতে পাকাঁপাকি ভাবে বসে অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবে কিছু কিছু বহুল প্রচারিত সবাদপত্রের স্নেহভাজন সাংবাদিকদের মাধ্যমে লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রচার চালাতে লাগলেন। আস্তে আস্তে দেশের সাধারণ মানুষও বিশ্বাস করতে শুরু করলেন, সিণ্ডিকেটের (কংগ্রেস) নেতারাই ব্যাক-সিট ড্রাইভিং করে দেশ চালাচ্ছেন। দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে আবিভূত হলেন এক মার্কিন সংবাদপত্রের দিল্লী সংবাদদাতা।
এই সংবাদদাতা সম্পর্কে একটু আলাদা করে বলা প্রয়োজন। ইনি ভারতীয়। জন্মস্থান পশ্চিম পাকিস্তানে। আসানসোল, রাণীগঞ্জ, ঝরিয়া অঞ্চলে কিছু কাল শ্রমিক আন্দোলন করেছেন। পরবর্তীকালে অজ্ঞাত কারণে মার্কিন দেশে কাটিয়েছেন বেশ কয়েক বছর। তারপর অকস্মাৎ দিল্লীতে আবির্ভাব এক মার্কিন সংবাদপত্রের সংবাদদাতারূপে। সিণ্ডিকেটের প্রায় প্রত্যেকটি নেতার সঙ্গে এর অত্যন্ত অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। নেতাদের বাড়ির অন্দরমহলে এর অবাধ যাতায়াত ছিল। এরই অনুপ্রেরণায় কংগ্রেসের কিছু নেতা মার্কিন দেশের আধুনিক ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে গভীর ভাবে পড়াশুনা শুরু করেন। বলা বাহুল্য এই সাংবাদিক-এর সুপারিশে মার্কিন দূতাবাস থেকে হাজার হাজার টাকার বই পৌঁছে যেত বিভিন্ন কংগ্রেসী নেতাদের বাংলোয়। মজার কথা, যেসব নেতারা এই সব বইপত্র উপহার পেতেন, পাণ্ডিত্যের জন্য তাদের কারুরই খ্যাতি ছিল না। বইপত্র ছাড়াও মাকিন দূতাবাস থেকে মাঝে মাঝে বাক্স ভর্তি সিগারেট-টিগারেটও কিছু নেতার বাড়ি যেত। শুধু তাই নয়, এই সাংবাদিক নিজে কিছু কিছু কংগ্রেসী নেতাকে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের আস্তানায় নিয়ে গেছেন।
এই সাংবাদিকের প্রতিপত্তির আরো একটা নজীর দিই। পার্লামন্টের সেন্ট্রাল হলে কোন বিদেশী সংবাদপত্রের সংবাদদাতার প্রবেশাধিকার নেই কিন্তু কোন অনুমতিপত্র ছাড়াই মার্কিন সংবাদ পত্রের এই সংবাদদাতা নিয়মিত সেন্টলি হলে যেতেন এবং সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গেই নিয়মিত আড্ডা দিতেন। অজ্ঞাত রহস্যজনক কারণে কংগ্রেস-কমিউনিষ্ট-সোস্যালিস্ট-জনসজ্ঞ দলের কোন এম-পিই এই সাংবাদিকের সেন্ট্রাল হলে নিয়মিত আড্ডা দেবার ব্যাপারে কোন আপত্তি জানাননি।