ঠিক এ সময় পার্টির সিদ্ধান্ত হলো গ্রামে যাবার। দাঙ্গার ভয়ে গ্রামের মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত। গ্রামে যেতে হবে। দাঙ্গার পরিবেশ ঠেকাতে হবে। পার্টির নেতা অনিল দাশ চৌধুরী। আমাকে তার সাথে যেতে হবে ভোলা মহকুমায়। সপ্তাহখানেক ভোলায় কাটালাম। তখনই চিনেছিলাম দৌলতখান, গুপ্তেরবন্দর, রাধাবল্লভ, বোরহানউদ্দিন, লালমোহন।
ভোলা থেকে ফিরে মন আরো খারাপ হয়ে গেল। দেখলাম সর্বত্র একটা দুঃখজনক অবিশ্বাস বিরাজ করছে। শতাব্দী ধরে যারা পাশাপাশি বাস করছিল তারা বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। আমার কাছে মনে হচ্ছিল ভারতবর্ষ বিভক্ত হলে কোনো চিন্তাভাবনা না করে হিন্দুরা এ দেশ ছেড়ে চলে যাবে।
কিন্তু আমরা কী করবো। বায়োজ্যেষ্ঠ অনিল দাশ চৌধুরী। মোজাম্মেল হক এমপ্লয়মেন্ট এক্সপ্রেসে চাকরি করেন। শামসুদ্দীনদা বিএ পাস করে কলকাতা চলে গেছেন। খালেকদা আছেন। এর পরে আমরা সবাই বয়সের দিক থেকে সমান।
নয়াদিল্লিতে তখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছে। এ সরকার হয়েছে সর্বদলীয়। এ সরকারের প্রেসিডেন্ট বড় লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার বল্লভভাই প্যাটেল। আর অর্থমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। ঠিক এ বছরই নয়াদিল্লিতে বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল আরএসপির প্রথম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। সম্মেলনে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয় যে, ভারতবর্ষ বিভক্ত হলে এই উপমহাদেশে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি স্থাপিত হবে। আর এই ঘাটি ব্যবহৃত হবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে।
তবে আমাদের কাছে মুখ্য প্রশ্ন হলো সে মুহূর্তে আমাদের ভূমিকা কী হবে? আমরা কিভাবে মূল্যায়ন করব ভারতের অন্তবর্তীকালীন সরকারকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ছাত্র ফ্রন্টের কাছে নির্দেশ এল ছাত্রদের নিজস্ব দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন শুরু করার। আমার এখন মনে পড়ে আমরা শিক্ষামন্ত্রীকে একটি স্মারকলিপি পাঠিয়েছিলাম এই নির্দেশ পাবার পর। তখন অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন সাফায়েত আহম্মদ খান।
আমরা তখন নিখিল বঙ্গ ছাত্র কংগ্রেসের সদস্য। আমাদের ছাত্র ফেডারেশনের নাম পাল্টাতে হয়েছে নিখিল ভারত কংগ্রেসের নির্দেশে। এ নির্দেশ মানতে মানতে উপমহাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন এসে যায়।
ভারত বিভাগ তখন অবশ্যম্ভাবী। এবার দাবি উঠেছে পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাগের জন্য। মনে হচ্ছে সারা ভারতবর্ষে ভারতবাসী বলে কেউ নেই। সকলেই হিন্দু বা মুসলমান। তাই দাবি উঠছে হিন্দু এলাকাগুলো ভারতের অন্তর্ভুক্ত হোক। মুসলিম এলাকাগুলো থাক পাকিস্তানে। এক সময় যারা বাংলা বিভাগকে মায়ের অঙ্গচ্ছেদ বলে মনে করত তারাই বাংলা বিভাগের দাবি করল সবচেয়ে আগে।
তখনকার একটি ঘটনা আমার চোখের সামনে ভাসে। নয়াদিল্লিতে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির মিটিং বসেছে। এ বৈঠকে ভারত বিভাগ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত হবে। এই বৈঠকে ভারত বিভাগের বিরুদ্ধে মাত্র দু’জন বক্তাই কথা বলছেন। একজন জয় প্রকাশের সমাজতান্ত্রিক দলের অরুণা আসফ আলী। অপরজন বাংলাদেশের রংপুরের অধিবাসী বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল আরএসপি’র সদস্য কমরেড সুনীল দেব।
কংগ্রেসের সভায় ভারত বিভাগ প্রস্তাব পাস হয়ে গেল। কংগ্রেসের অধিবেশন শেষ হলে সাংবাদিকরা এল অরুণা আসফ আলীর কাছে। সাংবাদিকরা বললেন বামপন্থীরা হেরে গেছে। বিক্ষুব্ধ অরুণা আসফ আলী বললেন, না দক্ষিণপন্থীরা জিতে গেছে। এটাই ছিল অরুণা আসফ আলীর কথা বলার ধরন। অরুণা আসফ আলীর জন্ম বরিশাল শহরে। নাম অরুণা গাঙ্গুলি। গ্রামের বাড়ি বরিশালের গৌরনদী। বিয়ে করেছিলেন কংগ্রেস নেতা আসফ আলীকে। খ্যাতি লাভ করেছিলেন ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়। আত্মগোপন করে আন্দোলন করেছিলেন। আবার একদিন ঘোষণা দিয়ে ব্রিটিশের চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন কলকাতার এক জনসভায়।
কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ দেশ বিভাগ মেনে নেবার পর বাংলা বিভাগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার চেষ্টা হয়েছিল বাংলাদেশে। দাবি করা হয়েছিল সার্বভৌম বাংলার। এ আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু, শহীদ সোহরাওয়াদী, অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগ সম্পাদক জনাব আবুল হাশিম, বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল আরএসপি ও ফরোয়ার্ড ব্লক। কিন্তু সে আন্দোলন তেমন কাজে আসেনি। সিন্ধু, গঙ্গা ও যমুনায় তখন অনেক জল গড়িয়েছে। আমাদের তখন ঘর গোছাবার পালা।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট গভীর রাতে দেশ ভাগ হয়ে গেল। গ্রামের পর গ্রাম থেকে হিন্দুরা চলে যেতে থাকল। ওপার থেকে এল পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের মুসলমানরা। ১৯৪৭ সালে পূজায় বাড়ি গেলাম। দেশের প্রায় সকলেই শঙ্কিত। সকলেই শেষ সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে। সকলেরই ধারণা এদেশে থাকা যাবে না। এদিকে আবার আরেক ঘটনা ঘটিয়েছে আমার আর এক কাকা। তিনি কংগ্রেস করতেন। ব্রিটিশ আমলে গহে অন্তরীণ ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট বাড়িতে পাকিস্তানের পতাকা উড়ালেন না। উড়ালেন কংগ্রেসের দলীয় পতাকা। যদিও কংগ্রেসের দলীয় পতাকা এবং ভারতের জাতীয় পতাকা এক নয়। তবুও এই দুই পতাকার অনেকটা মিল আছে। ভুল বুঝবার অবকাশ আছে। অনেকেই কাকার কংগ্রেসের পতাকা ওড়ানোকে ভারতের পতাকা বলে মনে করল। কাকার যুক্তি হচ্ছে যে কোনো উৎসব বা অনুষ্ঠানে আমার দলীয় পতাকা ওড়াবার অধিকার আছে। পাকিস্তান কংগ্রেস অবলুপ্ত হচ্ছে না। পাকিস্তানে কংগ্রেস থাকবে তাই তার পতাকাও থাকবে। তাই পতাকা ওড়াবার অধিকারও থাকবে।