চতুর্থ ঘটনা ঘটলো ২৯ জুলাই। ডাক ও তার কর্মচারীদের সমর্থনে সারা ভারতে হল। বক্ষের বিদ্রোহ থামানো কংগ্রেস, মুসলিম লীগ নেতাদের পক্ষে সম্ভব হলেও ২৯ জুলাইয়ের ঘটনায় রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হলো। ভারতের রাজনীতিতে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক সমাজের নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে শঙ্কিত করে তুলল। দীর্ঘদিন ধরে সারা ভারতে ডাক ও তার কর্মচারীরা ধর্মঘট করে আসছিল। তাদের সমর্থনে সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলো প্রথমবারের মতো সারা ভারতে হরতাল আহ্বান করে। ২৯ জুলাই সারা ভারতে হরতাল পালিত হলো। এবার শঙ্কিত হলো ব্রিটিশ, কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ। পাকিস্তানের দাবিতে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম আহ্বান করলো মুসলিম লীগ। ইংরেজিতে বলা হলো ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে। কিন্তু এই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম কার বিরুদ্ধে? জিন্নাহ সাহেব বা মুসলিম লীগ এ প্রশ্নের জবাব দিলেন না। ২৯ জুলাইয়ের ১৬ দিন পর ১৬ আগস্ট এলো। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের পরিণতি কলকাতায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। দেশে-বিদেশে প্রচারিত হলো গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং বলে। প্রমাণিত হলো ২৯ জুলাইয়ের শ্রমিক-জনতার ঐক্য ঠুনকো ঐক্য। ১৬ আগস্ট প্রমাণিত হলো হিন্দু-মুসলমান এক নয়। তারা পৃথক জাতি। তাদের পৃথকভাবে বসবাস করতে হবে। তাই মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র বাসভূমি চাই। সংখ্যালঘু মুসলমানদের বাঁচতে হবে মান-সম্মান, ইজ্জত এবং মর্যাদা নিয়ে। সুতরাং পাকিস্তান চাই।
আমি বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্র। সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে প্রায় জড়িয়ে গেছি। নিয়মিত আরএসপি অফিসে যাই। প্রবীণ নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ হয়। এদের গোটা জীবনের ইতিহাস কারাবরণের ইতিহাস। বরিশালে বিশেষ করে ছাত্রদের মধ্যে এদের প্রভাব প্রতিপত্তি প্রবল। ঐ চরম সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দিনেও এদের ছাত্র ফ্রন্টের প্রথম সারিতে মরহুম মোজাম্মেল হক, আবুল কালাম শামসুদ্দীন (পরবর্তীকালে শামসুদ্দীন আবুল কালাম), আব্দুল খালেক খান (পরবর্তীকালে সাংবাদিক), জাহিদ হোসেন জাহাঙ্গীর প্রমুখ। তখন দেখা হয়েছিল প্রণব ঘোষের সাথে। সদ্য জেলখানা থেকে এসেছেন। বিএ ক্লাসের ছাত্র। সরকারি নির্দেশে গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত। কলেজে আসতে পারতেন। তবে ক্লাসে ঢুকবার অনুমতি ছিল না। ক্লাসে ঢুকবার দুয়ারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুনতেন।
তখন আমরা ছাত্র ফেডারেশন (১৮ মির্জাপুর স্ট্রিট)-এর সদস্য। এই ছাত্র সংগঠনের ইতিহাসও বিচিত্র। ত্রিশের দশকে নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন গঠিত হয়। এই ছাত্র ফেডারেশনের ভাঙন আসে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। তখন কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। কমিউনিস্ট পার্টি ন্যাশনাল ফ্রন্ট (এন এফ) নামে কাজ করত। ১৯৪১ সালের জুন মাসে জার্মানি রাশিয়া আক্রমণ করলে কমিউনিস্ট পার্টি যুদ্ধকে জনযুদ্ধ বলে ঘোষণা করে। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির তখন কোনো প্রকাশ্য সংগঠন না থাকায় ছাত্র ফেডারেশনের মঞ্চ থেকে তারা যুদ্ধকে জনযুদ্ধ ঘোষণা দেয়। এতে তীব্র আপত্তি করে কংগ্রেস, ফরোয়ার্ড ব্লক, জয়প্রকাশ নারায়ণের কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টি ও বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল (আরএসপি)। এর পরিণতিতে নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন দুভাগ হয়। নিখিল ভারত ছাত্র কংগ্রেস গঠিত হয়।
তবে কংগ্রেসের নেতৃত্বে নিখিল ভারত ছাত্র কংগ্রেস গঠিত হলেও বাংলাদেশে তার ভিন্ন রূপ ছিল। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন ভেঙে গেলেও বাংলাদেশে আরএসপি’র নাম পাল্টাল না। কমিউনিস্ট প্রভাবিত ছাত্র সংগঠনটির নাম থাকল ছাত্র ফেডারেশন (১৮ মির্জাপুর স্ট্রিট)। কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠনের নাম হলো বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র কংগ্রেস। আর সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে মুসলিম লীগের ছাত্র প্রতিষ্ঠানের নাম নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন হলেও বাংলাদেশে তাদের ছাত্র সংগঠনের নাম হলো মুসলিম ছাত্রলীগ।
একদিন বরিশালে অশ্বিনীকুমার টাউন হলে গেলাম হিন্দু মহাসভার জনসভা শুনতে। ভাষণ দিচ্ছিলেন প্রখ্যাত ব্যারিস্টার নির্মল চ্যাটার্জি। তিনি খুব ঔদ্ধত্যপূর্ণ সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দিচ্ছিলেন। আমি উত্তেজিত হয়ে গেলাম। খেয়াল হলো আমার কাছে দাঁড়ানো আমার এক প্রাক্তন শিক্ষক। তার নাম রমেশ চ্যাটার্জি। কলসকাঠি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তিনি আমাকে থামাতে চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন, তুমি কি জান নোয়াখালীতে মুসলমানেরা হিন্দু মেয়েদের স্তন কেটে নিয়েছে? আমি বললাম, আমি এও জানি যে বিহারের হিন্দুরাও মুসলমান মেয়েদের স্তন কেটে নিয়েছে। মাস্টারমশায় আমার দিকে গভীরভাবে তাকালেন। আমি চলে এলাম। ঠিক বুঝতে পারলাম না শিক্ষকের মুখে জবাব দেয়া ঠিক হয়েছে কি না। সেকালে ছোটবেলা থেকে আমাদের শেখানো হতো গুরুজনদের কথায় জবাব দিতে নেই।
তবে এ ধরনের কথাবার্তা আমি কোনোদিনই মানিনি। তারও একটা পটভূমি ছিল। ১৯৪৪ সালে আমি বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হই। আমাদের বয়স তখন কম ছিল। আমরা জনাত্রিশ ছাত্র হাফপ্যান্ট পরে কলেজে আসতাম। সামনের বেঞ্চে বসতাম। লেখাপড়ায় খুব ভালো না হলেও সকলের ধারণা ছিল ছাত্র হিসেবে আমরা মন্দ নয়। পেছনের বেঞ্চের ছাত্ররা আমাদের এড়িয়ে যেত। তাই কথা বলায় আমাদের একটা অহমিকা ছিল। এই অহমিকা প্রকাশ পেত বিতর্ক শুরু হলে। দাঙ্গা আর সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে তর্ক শুরু হলে প্রায় একঘরে হয়ে যেতাম। কারো সাথে একমত হতে পারতাম না। কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম সাম্প্রদায়িক মনোভাব লক্ষ্য করতাম।