আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের খবরে সারাদেশ তখন অগ্নিগর্ভ। এর মধ্যে খবর এল যে, তাইপেতে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজী সুভাষ বসু মারা গেছেন। তিনি তাইপে থেকে বিমানে ব্যাংকক যাচ্ছিলেন। তাঁর এই মৃত্যুর খবর কেউ বিশ্বাস করল না। সন্দেহ আরো গম্ভীর হলো। এ সময় ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিল আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দি সেনানায়কদের বিচারের। বিচার হবে নয়াদিল্লির লালকেল্লায়। অভিযুক্ত নেতৃবৃন্দ হলেন কর্নেল শাহনেওয়াজ, ধীলন, সায়গল, রশিদ আলী, ঝাঁসির লক্ষ্মী বাই প্রমুখ। সারা ভারতবর্ষ ভেঙে পড়ল। উকিলের পোশাক পরলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু থেকে শুরু করে কংগ্রেসের সকল ডাকসাইটে নেতবৃন্দ। উল্লেখ্য যে, এঁরা ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় এ পেশা ত্যাগ ছিল।
আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃবৃন্দের বিচার বসবে নয়াদিল্লির লালকেল্লায়। সারা ভারতের মানুষের মুখে তখন আজাদ হিন্দ ফৌজের নাম। ঘরে ঘরে সুভাষচন্দ্র বসু, কর্নেল শাহনেওয়াজ, ধীলন, সায়গল, রশীদ আলী, লক্ষ্মী বাঈ-এর ছবি।
এই বিচারের বিরুদ্ধে ১৯৪৫ সালের ২১ নভেম্বর কলকাতায় মিছিল হলো। মিছিলে পুলিশের গুলিতে মার গেলেন রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। ঢাকায় বাড়ি। কলকাতার ছাত্র। ঢাকার বাসা হাটখোলা রোডে ঢাকেশ্বরী কটন মিলের কেন্দ্রীয় দফতরের কাছে। তাঁর কাকা সত্যেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এককালীন অনুশীলন সমিতি ও পরবর্তীকালের আরএসপি নেতা। দ্বিতীয় ঘটনা ঘটল ফেব্রুয়ারি মাসে। আমি তখন আইএসসি পরীক্ষার্থী। আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্যতম সদস্য রশিদ আলীর মুক্তির দাবিতে মিছিল নেমেছে কলকাতায়। মিছিলে গুলি হলো। নিহত হলেন আবদুস সামাদ। মুসলিম লীগ আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিকে নিজস্ব দাবি হিসেবে সাম্প্রদায়িক রং দেবার চেষ্টা করেও সফল হলো না। ব্রিটিশ সরকারের গুলি আবার সকলকে ঐক্যবদ্ধ করল।
আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতাদের মুক্তির দাবিতে সারা ভারতে আন্দোলন কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ নেতাদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিল। এককালে কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহেরু নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে ফ্যাসিস্টদের সহযোগী বলে অভিহিত করেছিলেন। সেই নেহেরুকে উকিল কোর্ট পরতে হয়েছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবির তীব্রতায়।
অপরদিকে মুসলিম লীগ দেখল–এ আন্দোলন সফল হলে ভারত স্বাধীন হবে, পাকিস্তান হবে না। তাই তারা আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সীমারেখা টানবার চেষ্টা করল। কর্নেল রশীদ আলীকে মুসলিম লীগের লোক বলে অভিহিত করে রশীদ আলী দিবস পালনের ডাক দিলেন। তাঁরা শাহনেওয়াজ, সায়গল বা লক্ষ্মী বাঈয়ের কথা বললেন না। কিন্তু কাজ হলো না। রশীদ আলীর মুক্তি আন্দোলনও সর্বজনীন রূপ পেল। ব্রিটিশের পুলিশ কাউকে ক্ষমা করল না মুসলমান বলে। আন্দোলন আরো তীব্র হলো। তৃতীর ঘটনা হলো–নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীতে বিদ্রোহ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সারা ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্র হয়। সামরিক বাহিনীতে তার প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে থাকে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বামপন্থীরা পরিকল্পনামাফিক কিছু রাজনৈতিক কর্মীকে সেনাবাহিনীতে ঢুকিয়েছিল। এরাই পরবর্তীকালে এ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলব।
এ পরিস্থিতিতে রাওয়ালপিন্ডিতে বিমানবাহিনীর সদস্যরা বিদ্রোহ করল। প্রকাশ্যে নৌবাহিনীর সদস্যরা বিদ্রোহ করুল বোম্বেতে। বোরে বিদ্রোহে শঙ্কিত হলো ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু এ বিদ্রোহ থামানো যাবে কিভাবে। বিদ্রোহীরা জাহাজে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও কমিউনিস্টদের লালঝাণ্ডা উড়িয়েছে। বোম্বেতে কার্ফু জারি করা হয়েছে। বিদ্রোহ দমন করা গেল না।
ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারলো কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ নেতাদের সহযোগিতা ব্যতীত এ বিদ্রোহ দমন করা যাবে না। তখন মুসলিম লীগ সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কলকাতা সফর করছিলেন। তাকে জরুরি ভিত্তিতে বম্বে আনা হলো। কংগ্রেসের দু’নম্বর জাঁদরেল নেতা বল্লভভাই প্যাটেল বম্বেতে ছিলেন। জিন্নাহ ও বল্লভভাই প্যাটেলকে বম্বের সমুদ্রতীরে কার্ফুর ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। তাঁরা মাইকে বিদ্রোহী নৌবাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। বললেন, শান্ত হও। দেশ স্বাধীন হবে।
কী অভিনব দৃশ্য! একজন ভারত ভাগ করে পাকিস্তান করতে চান–অপরজন অখণ্ড ভারত চান। এঁরা এক হলেন ব্রিটিশ সরকারের অনুরোধে বিদ্রোহ থামাতে। অর্থাৎ ব্রিটিশ সরকারের মতোই এঁরা কেউই চাইতেন না যে, ভারতবর্ষ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন হোক। কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ আসে স্বাধীনতা চেয়েছে। আপসে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চেয়েছে ব্রিটিশ সরকার। ভারতবর্ষে তার কোটি কোটি টাকার পুঁজি খাটছে। ভারতের উপর নির্ভর করে বেঁচে আছে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। সেই ভারতবর্ষ সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন হলে সবকিছু হারাতে হবে ব্রিটিশকে। সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা এলে মুসলিম লীগের পাকিস্তান হবে না। ক্ষমতা আসবে না কংগ্রেসের হাতে। তাই বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশ, কংগ্রেস, মুসলিম লীগ তিনপক্ষই একমত এবং ঐক্যবদ্ধ।