কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিল এ সহযোগিতা ও সাহায্যের সংজ্ঞা নিয়ে। বিপ্লব ব্যতীত অপর দেশের শ্রমিকশ্রেণি কীভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করবে, তার ব্যাখ্যা নিয়ে। স্ট্যালিনের বক্তব্য হলো, অপর দেশের শ্রমিকশ্রেণি তার নিজ দেশের সরকার সম্পর্কে নীতি নির্ধারণ করবে সেই দেশের সরকারের সোভিয়েত ইউনিয়ন সংক্রান্ত নীতির ওপর ভিত্তি করে। কোনো দেশের সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে হলে সে দেশের কমিউনিস্ট পার্টি সে দেশের সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করবে। একইভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে কোনো দেশের সরকারের সম্পর্ক ভালো থাকলে কমিউনিস্ট পার্টি সে দেশের সরকারের সাথে সহযোগিতা করবে।
প্রবীণ বিপ্লবীদের ভাষায়–এ হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়নকে অন্ধ অনুকরণের নীতি। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর এ নীতি অনুসরণ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টি। প্রথমে এরা জার্মানির বিরুদ্ধে টু শব্দটি করেনি। কারণ জার্মানির সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনাক্রমণ চুক্তি ছিল। জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করার পরই তারা জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এবার তারা বলেছেন-জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করেছে। সুতরাং জার্মানি আমাদের শত্রু। জার্মানি ব্রিটেনকে আক্রমণ করেছে-সুতরাং আক্রান্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেন পরস্পরের মিত্র। ব্রিটিশ সোসাভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র হওয়ায় ব্রিটিশ ভারতেরও মিত্র। সুতরাং যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় ব্রিটিশকে বিপর্যস্ত করা যাবে না। এতে ভারতের স্বাধীনতা বিলম্বিত হলেও করার কিছু নেই। সোভিয়েত সমাজতন্ত্র রক্ষার জন্য সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশকে সহযোগিতা করারই একমাত্র কাজ।
অনুশীলন সমিতির প্রবীণ বিপ্লবীরা এ তত্ত্ব মেনে নেননি। তাই তাঁরা লেনিনের পথকে অনুসরণ করে গড়ে তুলেছিলেন বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল। সেই অর্থে বলা যায়, বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল আরএসপি ছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে গঠিত কমিউনিস্ট পার্টির বিকল্প বিপ্লবী দল। এ দুটি দলের তাত্ত্বিক বিতর্ক ছিল তীক্ষ্ণ এবং তীব্র। ১৯৪৫ সালের শেষের দিকে এই বিপ্লবীদের সাথে আমার পরিচয় ঘটে। এ দলের নেতারা তখনও জেল থেকে মুক্তি পাননি। এক নাগাড়ে প্রায় চৌদ্দ-পনের বছর এদের জেলে থাকতে হয়েছে।
১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনের সময় এদের গ্রেফতার করা হয়। ১৯৩৮ সালে এঁদের মুক্তি দেয়া হয়। আবার ১৯৪০ সালে আরএসপি গঠনের ছ’মাসের মধ্যে সকলেই গ্রেফতার হয়ে যান। তবে সকলেই ছাড়া পান ১৯৪৬ সালে সাধারণ নির্বাচনের পর। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়ে সকল বন্দিদের মুক্তি দেন।
এই প্রবীণ বিপ্লবীদের সাথে আলোচনার ফলে আমাদের দীর্ঘদিনের সংশয় কেটে যায়। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় কমিউনিস্ট পার্টির আচরণ আমাকে বেদনার্ত করেছিল। আরএসপির বিপ্লবীদের সংস্পর্শে এসে আমি সেদিনের কমিউনিস্ট পার্টির আচরণের একটি ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম। এই ব্যাখ্যাই আমাকে বলে দিল–কমিউনিস্ট পার্টিতে অনেক সংগ্রামী এবং বিশ্বস্ত নেতা কর্মী থাকলেও অন্ধ অনুকরণ তাদের বিপর্যস্ত করবে। অন্ধ অনুসরণ ও অনুকরণের নীতির ফলে ভারতের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবে সুদূর পরাহত। কারণ ‘আমি চাই বা না চাই কমিউনিস্ট পার্টিই তখন সমাজতন্ত্রের পক্ষে সবচেয়ে বড় শক্তি বলে পরিগণিত’-এই পটভূমিতেই আমার আরএসপির সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
তবে সে সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৪৬ সালে সকল নেতাই মুক্তিলাভ করেন। ১৯৪৬ সালেই সারা ভারতবর্ষে ভয়াবহ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়। আর এর পূর্বে ঘটে যায় কয়েকটি যুগান্তকারী ঘটনা। প্রথম ঘটনাটি ঘটে ১৯৪৫ সালে ২১ নভেম্বর। কলকাতার ছাত্ররা আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতাদের যুক্তির দাবিতে মিছিল করছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। লক্ষ্য ছিল নিজের শক্তিতে সশস্ত্র অভিযানের মাধ্যমে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করা। জাপান সরকার আজাদ হিন্দ ফৌজকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ ইলের কোহিমা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছিল ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে। সেই সময় পেছন থেকে জাপান বিশ্বাসঘাতকতা করল। সর্বশেষে জাপান বুঝতে পেরেছিল যে, সুভাষচন্দ্র বসু তাদের ওপর নির্ভর করবেন না। তাদের কথা শুনবেন না। সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের বিরোধের সুযোগ নিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বে ভারতবাসীরাই ভারতবর্ষ স্বাধীন করবে। এ পরিস্থিতি জাপানের কাছে কাম্য ছিল না। তারা ভেবেছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের কাঁধে সওয়ার হয়ে ভারতবর্ষ দখল করবে। সে স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ায় তারা আজাদ হিন্দ ফৌজকে সকল সাহায্য ও সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়। পর্যদস্ত আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে বন্দি হলেন। ইতোপূর্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের দুই প্রতিনিধি হরিদাস মিত্র ও পবিত্র রায় বিশেষ বার্তা নিয়ে সাবমেরিনে উড়িষ্যার উপকূলে পৌঁছলে গ্রেফতার হয়ে যান। বিচারে তাদের প্রাণদণ্ড হয়। গান্ধীজীর হস্তক্ষেপে প্রাণদণ্ড স্থগিত হয়ে যায়।