কংগ্রেসের সভাপতি না বলে আমরা বলতাম রাষ্ট্রপতি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। তাকে মুসলিম লীগের ছেলেরা গালাগালি করত। কমিউনিস্ট পার্টির নেতারাও তাঁকে সমালোচনা করল। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এরপর থেকে তাদের এড়িয়ে চলতাম। কলসকাঠি থাকাকালীন এরপর কোনোদিন তাদের সাথে ভালোভাবে কথাও বলিনি। এর মাঝখানে আর একটি ঘটনা ঘটে গেল। একদিন ভোরের দিকে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেল লঞ্চের বাঁশিতে। ছুটে স্কুলের পাশে খালপাড়ে এলাম। এসে দেখি লঞ্চ ভর্তি পুলিশ আর গুর্খা সৈন্য। প্রায় সব নেতাই গ্রেফতার হয়ে গেছেন। সবাইকে লঞ্চে তোলা হচ্ছে। আমাকে দেখে গাঙ্গুলী জমাদার কাছে এলেন। বললেন তোমাদের ঘন্টার কী হলো? আজ ঘণ্টা বাজল না! বুঝলাম, কেউ টের পাইনি। কাউকে খবর দিতেও পারিনি। চারদিকে তখন ভয় আর ভয়। পুলিশ কাকে গ্রেফতার করবে তা কেউ বলতে পারে না। তখন কেউ গ্রেফতার হলে আমরা রঙ্গী যাই না। বন্দিদের বিদায় দিতে কেউ স্টিমার ঘাটে যায় না। গ্রামে গ্রামে পুলিশ নেমেছে। নেমেছে পুলিশের কেউ। কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। আর এমন সময় ব্রিটিশ সরকার নামল নতুন দণ্ডনীতি নিয়ে। দশ হাজার টাকা পাইকারি জরিমানা ঘোষণা করা হলো। বলা হলো, যে সম্প্রদায়ের লোক গ্রেফতার হবে বা গ্রেফতারের তালিকায় যাদের নাম থাকবে সেই সম্প্রদায়ের লোককেই এই জরিমানা দিতে হবে। এই ঘোষণার সাথে সাথে এক শ্রেণির মানুষ জরিমানা না দেয়ার ফিকিরে নামলেন। দালালির খাতায় নাম লেখালেন অনেকে। সকলেরই চেষ্টা নিজের সম্প্রদায়কে বাঁচাবার। এ আন্দোলনে মুসলমান সম্প্রদায়ের কাউকে জরিমানা দিতে হলো না। ভাগ করা হলো হিন্দুদের মধ্যেও। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, কামার-কুমার, কুলি বা শাঁখারীর ভিত্তিতে। যাদের সম্প্রদায়ের লোক অভিযুক্ত নয় তাদের জরিমানা নেই।
কলসকাঠির স্কুলের কাছে আমি থাকতাম। ঐ স্কুলেই সরকারি কর্মকর্তারা এলেন। সারাদিন ভরে জরিমানা আদায় করলেন। আমরা দূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। প্রতিবাদ করার কেউ ছিল না। বরিশাল জেলায় শুধুমাত্র কলসকাঠি ও রহমতপুরে ভারত ছাড়ো আন্দোলন তীব্র হয়েছিল। আর কোথাও আন্দোলন তেমন ছড়িয়ে পড়েনি। গান্ধীবাদী কংগ্রেস এই আন্দোলনে এসেছিল নেহায়েত বাধ্য হয়ে। কমিউনিস্ট পার্টি আন্দোলনে আসেনি। বরিশালে সুভাষচন্দ্র বসুর ফরোয়ার্ড ব্লক কোনোদিনও গঠিত হয়নি। মোটামুটিভাবে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল আরএসপি বরিশালে সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতিনিধিত্ব করত। আরএসপিও তখন তেমনভাবে সংগঠিত হয়নি। এককালের অনুশীলন সমিতির অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা জেলখানায় মার্কসবাদ গ্রহণ করেন। কিন্তু লেনিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা তাঁরা সঠিক বলে মনে করেননি। ১৯৪০ সালের ১৯ মার্চ তাঁরা আরএসপি গঠন করেন এবং ঘোষণা করেন যে, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সুযোগে ব্রিটিশকে হটাতে হবে। এ ঘোষণা দিয়ে এরা কেউই বেশিদিন বাইরে থাকতে পারেননি। দীর্ঘদিন কারাবাসের পর ১৯৩৮ সালে তারা মুক্তি পেয়েছিলেন। দল গঠনের ছয় মাসের মধ্যে প্রথম শ্রেণির সকল নেতাই আবার গ্রেফতার হয়ে গেলেন। তবুও তাঁদের নেতৃত্বেই রহমতপুরে আন্দোলন হয়েছিল। কলসকাঠিতে মুখ্যত আন্দোলন ছিল গান্ধীবাদীদের হাতে।
১৯৪৪ সালে আমি বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হলাম। ১৯৪৫ সালের শেষের দিকে এককালীন অনুশীলন সমিতির প্রবীণ বিপ্লবীদের সাথে আমার পরিচয় হয়। এ পরিচয় আমাকে কৌতূহলী করে। এ বিপ্লবীরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ গ্রহণ করেছেন। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করতে চান। অথচ কমিউনিস্ট পার্টি করেন না। এঁদের সুস্পষ্ট বক্তব্য, লেনিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভুল পথ অনুসরণ করেছে। ফলে বিশ্ববিপ্লব হয়নি এবং এই মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের দ্বারা কোনো দেশেই বিপ্লব হবে না।
তাহলে লেনিনের পথটা কী? কোন পথ থেকে স্ট্যালিন বিচ্যুত হয়েছেন? প্রবীণ বিপ্লবীদের কথায় এ বিতর্ক বিশ্বসমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নিয়ে। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে রক্ষা নিয়ে এ প্রশ্নে বিপ্লবের তিন নেতা-লেনিন, ট্রটস্কি এবং স্ট্যালিন একমত হলেন না। প্রথমদিকে স্ট্যালিন লেনিনের মতই পোষণ করতেন। দু’জনেরই বক্তব্য হচ্ছে–একটি দেশের সমাজতন্ত্রের বিজয় সম্ভব হলেও পূর্ণ বিজয় আদৌ সম্ভব নয়। তাঁদের অভিমত বুর্জোয়া দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠন শুরু করা যায়নি। কিন্তু একাধিক উন্নত ধনবাদী দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন না হলে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র রক্ষা করা সম্ভব নয়। সমাজতন্ত্রের পূর্ণ বিজয়ও সম্ভব নয়।
ট্রটস্কির বক্তব্য ছিল পুঁজিবাদী বেষ্টনের পরিবেশে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণও শুরু করা যাবে না। তাঁর কথায় এক দেশে সমাজতন্ত্রের বিজয়ও সম্ভব নয়। অর্থাৎ এক দেশে সমাজতন্ত্রের বিজয়ের প্রশ্নে একদিকে লেনিন ও স্ট্যালিন অপরদিকে ট্রটস্কি অবস্থান নিলেন। এ চিত্রের পরিবর্তন ঘটল ১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যুর পর। ১৯২৫ সালে স্ট্যালিন বললেন, অপর কোনো দেশে বিপ্লব ছাড়াই সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্রের পূর্ণ বিজয় সম্ভব। তাঁর কথা হচ্ছে বিপ্লবের পরিবর্তে অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের সহযোগিতা ও সাহায্যের উপর নির্ভর করে পূর্ণ বিজয় সম্ভব।