সেই টেলিগ্রাফ অফিস আক্রান্ত হলো ১৯৪২ সালে আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে। স্টিমার অফিসও পুড়িয়ে দেয়া হলো। আমরা তখন উৎসাহী দর্শক। কলসকাঠি বাকেরগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত। মাঝখানে নদী। নদীর ওপারে থানা। সেখানে স্পিডবোট ছিল না। পুলিশকে নৌকায় যাতায়াত করতে হতো। জরুরি প্রয়োজন দেখা দিলে পুলিশ লঞ্চ ব্যবহার করত। কলসকাঠি থানা সদর থেকে দূরে হওয়ায় সেদিনই পুলিশের আবির্ভাব ঘটল না। পুলিশ এল পরের দিন। নেতৃস্থানীয় চারজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। প্রথমদিনে আর কাউকে গ্রেফতার করতে পারল না।
সে এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি। পুলিশ নেতাদের গ্রেফতার করে বাকেরগঞ্জ থানায় নিয়ে যাচ্ছে। পরদিন তাদের পাঠানো হবে স্টিমারে বরিশাল। আমরা তাদের বিদায় দেবার জন্যে বাকেরগঞ্জ থানায় গেলাম। স্টিমার স্টেশনের নাম রঙ্গশ্রী। দুপুরের দিকে পটুয়াখালী থেকে বরিশালগামী স্টিমার আসত। স্টেশনে অসংখ্য মানুষ ভিড় জমত। মেয়েরা গান গাইত। বন্দিদের গলায় মালা দিত। পুলিশ তেমন কিছু বলত না।
রঙ্গশ্রীর কথা মনে হলে এখনও আমার চঞ্চলাদির কথা মনে পড়ে। কলসকাঠিতে আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতেন চঞ্চলাদির আত্মীয়রা। চঞ্চলাদির বাড়ি ছিল বিক্রমপুরের শ্যামসিদ্ধি, থানা শ্রীনগর। স্বামী বাকেরগঞ্জে চাকরি করতেন। কী চাকরি করতেন তা আর এখন মনে নেই। চঞ্চলাদি বড্ড ফর্সা ছিলেন। ফর্সা ছিল তার চোখের তারা। সেই চঞ্চলাদিকেও দেখতাম বন্দিদের বিদায় দেয়ার জন্যে স্টিমার স্টেশনে আসতেন। চঞ্চলাদি আদর্শ গৃহবধূ। সাত চড়ে কথা বলেন না। তিনি কী করে স্টিমার স্টেশনে আসতেন বা কেন আসতেন তা আমিও বুঝতে পারিনি।
ঐ চঞ্চলাদিদের বাকেরগঞ্জের রঙ্গশ্রী ছেড়ে সন্ধ্যার দিকে আমরা কলসকাঠি ফিরতাম। ইতোমধ্যে আমাদের কর্মসূচি নির্ধারণ হয়ে গেছে। আমাদের একমাত্র কাজ নেতাদের খবর দেয়া এবং নেয়া। পুলিশের পক্ষ থেকে অসংখ্য লোকের নামে ইতোমধ্যে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। নেতারা আত্মগোপন করেছেন। প্রতিদিন রাতে পুলিশ ঘেরাও করছে বাড়ি। আমরা কয়েকটা ঘন্টার ব্যবস্থা করেছি। পুলিশের খবর পেলেই ঘন্টা পিটানো হতো। নেতারা পালিয়ে যেতেন। দিনের পর দিন পুলিশ এসে ফিরে যেত। সেকালের এক জমাদারের কথা এখনও মনে পড়ে। পুরো নাম কখনো শুনিনি। নাম ছিল গাঙ্গুলী জমাদার। গাঙ্গুলী খুব ধুরন্ধর। কোনো নেতাকে খুঁজে না পেয়ে তিনি আমাদের খোঁজ করতেন। কাছে এসে নানা কথা জিজ্ঞাসা করতেন। কিন্তু কোনো দিনই কোনো কথা বের করতে পারেননি। কিন্তু আমাদের সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করেননি।
তখন প্রতিদিন বিকালে মিছিল হতো। একদিন মিছিলে কয়েকজন কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের দেখলাম। দেখলাম তারা আমাদের মিছিলে যোগ দিয়েছে। কিছুটা অবাক হলাম। শুনেছিলাম কমিউনিস্ট পার্টি ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন সমর্থন করে না। তারা সে মুহূর্তে ব্রিটিশকে বিব্রত করতে চায় না। তাই তাদের দেখে প্রথমে খুব ভালো লাগল। ভাবলাম কমিউনিস্ট পার্টি বোধ হয় আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। আমাদের মধ্যে যাদের বয়স কম ছিল সবাই ভাবতাম আন্দোলনে সকলের আসা উচিত। একদিন মিছিল করতে করতে শুনলাম, মুসলিম লীগ সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও নাকি গ্রেফতার হয়েছেন। এ খবরে মিছিলটা যেন অগ্নিগর্ভ হয়ে গেল। ভাবলাম এবার ব্রিটিশের রক্ষা নেই। এবার ব্রিটিশকে যেতেই হবে।
কিন্তু খবরটা সত্যি ছিল না। বাসায় ফিরে পিসেমশাইয়ের কাছে শুনলাম খবরটা সত্যি নয়। পিসেমশাই কলসকাঠি স্কুলের গণিতের নামজাদা শিক্ষক ছিলেন। পিসেমশাইর সুবাদেই আমার কলসকাঠি যাওয়া। তাঁর বাসায় থেকেই স্কুলে পড়তাম। সেদিন পিসেমশাইর কাছে খবর শুনে যেমন বিমর্ষ হয়েছিলাম তেমনি আবার কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের দেখে উফুল্লও হয়েছিলাম।
কলসকাঠির পাশের গ্রাম গাডুরিয়া। গাডুরিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির কিছু লোক আছে জানতাম। তারাই সেদিন এসেছিলেন মিছিলে। শেষ পর্যন্ত তাঁদের কথায় আমার চমক ভাঙল। কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা আমাদের কয়েকজন ছাত্রকে ডেকে মিছিল থেকে দূরে নিয়ে গেলেন। মাথায় হাত বুলালেন, আমাদের খুব প্রশংসা করলেন। তারপর এক সময় বললেন, তোমরা ভুল করছ। এভাবে স্বাধীনতা আসবে না। কংগ্রেস নেতারা জার্মানি ও জাপানের দালাল। সুভাষচন্দ্র বসু বিশ্বাসঘাতক। ওরা ভারতবর্ষকে জাপানের হাতে তুলে দিতে চায়। এ যুদ্ধ হচ্ছে জনযুদ্ধ। জার্মান সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করেছে। জার্মান আগে আক্রমণ করেছে ব্রিটেনকে। আক্রান্ত ব্রিটেন এবং আক্রান্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন বন্ধু। সমাজতন্ত্র বাঁচাতে হলে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বাঁচাতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নকে বাঁচাতে হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র ব্রিটেনকে এখন বিব্রত করা চলবে না। সুতরাং এখন ব্রিটিশকে বিব্রত করলে ফ্যাসিবাদী জার্মান ও জাপান জিতে যাবে। তাই এখন যারা ব্রিটিশকে বিব্রত করতে চায় তারা বিশ্বাসঘাতক এবং ফ্যাসিবাদী শক্তির মিত্র। সুভাষ বসু এই ষড়যন্ত্র করার জন্যে জার্মান গেছেন। বার্লিন বেতার থেকে ভাষণ দিয়েছেন। তিনিও ফ্যাসিস্টদের দালাল। তাই কংগ্রেস ও সুভাষচন্দ্র বসুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। সমাজতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে, জাপানের হাত থেকে ভারতকে রক্ষা করতে হলে ব্রিটেনের সাথে সহযোগিতা করতে হবে। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করতে হবে। তখন আমি নবম শ্রেণির ছাত্র। রাজনীতিতত্ত্ব তেমন বুঝতাম না। অবাক বিস্ময়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের কথা শুনলাম। তাদের সাথে বিতর্ক করার মতো বুদ্ধি আমার ছিল না। শুধুমাত্র সুভাষচন্দ্র বসুকে গালি দেয়ায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে তেমন দুর্বলতা আমার সে বয়সেও ছিল না। গালভরা আবুল কালাম আজাদ নামটি বলতে গেলে তা ভালো লাগত।