১৯৪২ সাল এসেছিল আমার কাছে ভিন্নভাবে। কলসকাঠি পড়তে এসে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব আরো তীব্র হয়ে উঠল। শৈশব থেকে আমার অভ্যাস ছিল পত্র-পত্রিকা খুঁটেখুটে পড়া। স্কুল জীবনেই সংবাদপত্রের খবর রাখতাম। কংগ্রেস-এর নাম জানতাম। মুসলিম লীগের নাম জানতাম। কমিউনিস্ট পার্টির কথাও শুনেছি। সুভাষচন্দ্র বসুর জন্যে আবেগও ছিল।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর দেখেছি কংগ্রেসের সাথে ব্রিটিশ সরকারের বনিবনা হচ্ছে না। কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারকে শর্ত দিয়েছে স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি না দিলে যুদ্ধে সহযোগিতা করবে না। মুসলিম লীগের অভিমত একটু ভিন্ন ধরনের। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহণ করে। এ প্রস্তাবের মর্মকথা হচ্ছে, ব্রিটিশকে ভারত ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু যাওয়ার আগে ভারত ভাগ করে যেতে হবে। মুসলমানদের জন্যে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টি করতে হবে। অপরদিকে কংগ্রেসের ছিল অখণ্ড ভারতের আন্দোলন। মুসলিম লীগ কংগ্রেস ব্রিটিশবিরোধী প্রতিটি আন্দোলনকেই অখণ্ড ভারতের আন্দোলন বলে মনে করত। তাই কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে এ ধরনের পরিস্থিতি তখন ছিল না। অথচ ঐ বয়সে আমি অন্তত এ ধরনের একটি ঐক্যের পক্ষপাতি ছিলাম না। ভাবতাম এমন হলে কেমন হয়। সবসময় মনে হতো হিন্দু-মুসলমান ঐক্যবদ্ধ না হলে ভারতের স্বাধীনতা আসবে না।
আমার এ চিন্তার হয়তো একটি পটভূমি ছিল। আমার বাড়ি আজকের গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া হলেও পাঠশালা ব্যতীত কোটালীপাড়ার কোনো বিদ্যালয়েই আমি পড়িনি। পাঠশালার পরে আমার প্রথম পাঠ শুরু হয় গোপালগঞ্জের গিমাডাঙ্গা টুঙ্গিপাড়া এম.ই স্কুলে।
এই এলাকায় শতকরা ৯০ জনই মুসলমানের বসবাস। আমার দুই কাকা এখানে চিকিৎসা পেশায় খ্যাতিলাভ করেছিলেন। এই স্কুলে পড়ার ফলে আমার ভিন্ন মানসিকতার জন্ম হয়। হয়তো সেই মানসিকতাই পরবর্তীকালে আমার জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। আমি সপ্তম শ্রেণিতে এসে কলসকাঠিতে ভর্তি হই। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়েছে। কংগ্রেসের সাথে ব্রিটিশের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রশ্নে আপসহীন ভূমিকা নিয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ সরকার ব্রিটিশ শ্রমিক দলের নেতা স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস-এর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পাঠাল ভারতে। উদ্দেশ্য আপসে কংগ্রেসের সাথে একটি রফা করা। মূল বক্তব্য হচ্ছে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দেয়া হবে। তার পূর্বে নয়। তখন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন উইনস্টন চার্চিল। এই ভভদ্রলোককে আমি আদৌ পছন্দ করতাম না। তিনি বলেছিলেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে ভেঙে ভেঙে টুকরো করার জন্যে তিনি ক্ষমতায় আসেননি। তাঁর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, তিনি ক্ষমতাসীন থাকা পর্যন্ত ভারত স্বাধীন হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস-এর দৌড় ব্যর্থ হয়ে গেল। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে চরমপত্র দেয়া হলো। ১৯৪২ সালের ৮ আগস্টের মধ্যে ভারতকে স্বাধীনতা দেয়া না হলে ৯ আগস্ট থেকে কংগ্রেস ভারত স্বাধীন করার লক্ষ্যে চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু করবে।
ব্রিটিশ সরকার কোনো হুমকিতেই কান দিল না। ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট বোষেতে কংগ্রেসের অধিবেশন থেকে ঘোষণা হলো সংগ্রামের কর্মসূচি। তখন কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। মহাত্মা গান্ধী শ্লোগান দিলেন, করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে-ডু অর ডাই। বোম্বেতে কংগ্রেসের অধিবেশন থেকেই কংগ্রেস নেতাদের গ্রেফতার করা হলো। কংগ্রেস নেতারা সংগ্রামের কৌশল সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণা না দিয়েই জেলে চলে গেলেন। সারা ভারতবর্ষে অসংগঠিত বিক্ষুব্ধ জনতা রেল লাইন উপড়ে ফেলল। ডাকঘর এবং সরকারি ভবনে আগুন দেয়া শুরু হলো। সেই সংগ্রামের ঢেউ বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ থানার কলসকাঠিতেও আঘাত হানল। আমরা আন্দোলনে শরিক হলাম। আমি তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। ক্লাসে বয়সের দিক থেকে সর্বকনিষ্ঠ। স্কুলের গেটে শুয়ে ১৬ দিন ধর্মঘট করলাম। এর মধ্যে অনেক ঘটনা ঘটে গেল।
১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন দুটি দিকে আমার চোখ খুলে দিল। কৈশোরে নিজের চোখে দেখলাম ব্রিটিশের দণ্ডনীতি, বিভেদ নীতি এবং কমিউনিস্ট পার্টির দুঃখজনক আচরণ।
কলসকাঠিতে তেমন কোনো স্বদেশী আন্দোলন ছিল বলে আমি জানতাম না। মাইলখানেক উত্তরে বেবাজ গ্রাম। সে গ্রামে রাজনৈতিক কর্মীদের একটি আশ্রম ছিল। আশ্রমের নাম ‘গান্ধী আশ্রম’। সে আশ্রমের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল না। কলসকাঠি স্কুলের কাছে কোয়ার্টারে থাকতাম। স্কুলের দক্ষিণে ডাকঘরের সামনে ছোট একটি মাঠ ছিল। সেই মাঠেই একদিন সভা জমে উঠল। সভায় বক্তারা তীব্র ভাষায় ব্রিটিশ সরকারের সমালোচনা করল। গান্ধী, নেহেরু ও মওলানা আজাদের মুক্তির দাবি হলো। পত্রিকায় খবর আসছিল সারা ভারতে বিক্ষোভের। বিক্ষুব্ধ জনতা ট্রেন লাইন উপড়ে ফেলছে। ডাকঘর ও স্টেশনে স্টেশনে আগুন দিচ্ছে। আগুন দিচ্ছে সরকারি বাসভবনে। কলসকাঠিতে তেমন সরকারি ভবন ছিল না। তারও একটি ইতিহাস আছে।
কলসকাঠি উন্নত গ্রাম। তের ঘর জমিদারের বসবাস। তাদের একটি ডাকঘর চাই। টেলিগ্রাফ অফিস চাই। কিন্তু সেকালে থানা সদরের বাইরে টেলিগ্রাফ অফিস দেয়া হতো না। সরকারের শর্ত ছিল প্রয়োজনীয় সংখ্যক টেলিগ্রাফ না হলে টেলিগ্রাফ অফিস দেয়া যাবে না। কলসকাঠির জমিদারেরা এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। তারা প্রতিদিন সকালে ও বিকালে বরিশাল থেকে কলসকাঠিতে টেলিগ্রাফে খবর পাঠানো রু করলেন। ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে কলসকাঠি বাজারে টেলিগ্রাফ অফিস চালু করল।