সময়টা ছিল অস্বস্তিকর ও অনিশ্চিত। তখন ফাল্গুন মাস। হঠাৎ যেন মনে হলো দক্ষিণের বাতাস এসে সব পুরনো পাতা ঝরিয়ে দিল। ঢাকা জেলের তখন পুরনো হাজতে আছি। তিন দিকে উঁচু উঁচু দেয়াল। বারবার চোখ দেয়ালে ধাক্কা খায়। এককালে ওখানে ২০ জন বন্দি ছিলেন। ৬ মাসের মধ্যে ১৯ জনকে চশমা নিতে হয়েছিল। আমি দক্ষিণ দিকে ঘরে থাকতাম। পাশে উঁচু দেয়াল। সেই দেয়াল ছাড়িয়ে একটি অশ্বথ গাছ। সেই অশথ গাছের পাতা ঝরা ও নতুন নতুন পাতা দেখে বছরের পর বছর ঋতু পরিবর্তন লক্ষ করতাম।
সেই দেয়ালের জগতে ২১ ফেব্রুয়ারি একজন সিপাহি এল। পরনে লুঙ্গি। একটি ব্যাগে তার প্যান্ট ও জামা। সে এসে বলল, দেশ দোজখ হয়ে গেছে। চারিদিকে গুলি আর গুলি। বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি হয়েছে। অসংখ্য ছাত্র মারা গেছে। সে ভয়ে সরকারি জামা-কাপড় পরে জেলে ঢুকতে পারেনি। লুঙ্গি পরে ঢুকেছে।
আমরা চমকালাম। কিভাবে চমকেছিলাম বর্ণনা করা যাবে না। পূর্ববাংলা অর্থাৎ পাকিস্তানে এমন ঘটনা ঘটতে পারে আমরা তা আশা করিনি। সবার মনে ছিল মুক্তি পাবার চিন্তা। এটা জানা ছিল যে, সহজে মুক্তি হচ্ছে না। আমাদের মুক্তির জন্য কেউ আন্দোলনও করবে না। হঠাৎ যেন সবকিছু পাল্টে গেল। সন্ধ্যার দিকে জেলখানায় নতুন কণ্ঠের ধ্বনি শোনা গেল। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সমগ্র জেলখানা মুখরিত। একদল তরুণ ঢাকা জেলে ভরে গিয়েছে। ওরা কিছু মানে না। ওরা কিছু মানতে চায় না। কিন্তু আমাদের কারো সাথে ওদের দেখা হলো না। কারণ রাজনীতির ভাষায় আমরা ‘বি ক্লাস’। অর্থাৎ আমরা দাগী আসামী। আমাদের সাথে ওদের রাখা চলে না। আমাদের সাথে এলে ওরা খারাপ হয়ে যাবে।
কিন্তু আমরা কী করবো? দেশে গুলি হবে। হত্যা হবে। তাতে আমাদের কিছুই করার নেই। জেলে বন্দি আছি বলে কি কিছুই করতে পারব না। সিদ্ধান্ত হলো পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি আমরা ২৪ ঘন্টা অনশন করব। অথচ অনশন করবার মতো স্বাস্থ্য কারও ছিল না। ২২ ফেব্রুয়ারি ভোরে এক সিপাহি লুকিয়ে একটি আজাদ পত্রিকা দিয়ে গেল। পত্রিকাটিতে বড় করে আছে আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিনের পদত্যাগের খবর। খবর আছে খয়রাত হোসেন ও আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ-এর। ভেতরে খবর আছে মিছিল, গুলি আর আন্দোলনের।
আমরা সবাই উজ্জীবিত। কিন্তু শরীর বড্ড দুর্বল। ২৪ ঘণ্টার অনশনও যেন শেষ করা যাচ্ছিল না। রাত ১২টায় আমার জন্য চিকিৎসক এলেন। বললেন–কোনো কিছু না খেলে অঘটন ঘটে যেতে পারে। আমি বছরখানেক ধরে স্বাভাবিক খাবার খেতে পারছিলাম না। দীর্ঘদিন অনশনে শরীর ভেঙে গিয়েছিল। বছর দুয়েক ধরে দুবেলা বার্লি খেতাম। অন্য কিছু সহ্য হতো না। বন্ধুরা বললেন, কিছু খেতে হবে। আমি বললাম–শুধুমাত্র ধনে ভিজানো জল পেলেই হবে। ঐ জল খেলেই বমি বমি ভাব কেটে যাবে–আমি ঘুমিয়ে যাব। তারপর ২৩ ফেব্রুয়ারির ভোর এল। আমার আর উঠবার শক্তি ছিল না। সারা জেলখানায় তখন তারুণ্যের কলরব আর কোলাহল। জেলখানায় ২১ ফেব্রুয়ারি এল নতুন বাতাসের মতো। ১৯৪৮ সালে জেলে এসেছিলাম। ১৯৫০ সালে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল। সেই দাঙ্গার পর আন্দোলনের প্রত্যাশা দিনের পর দিন ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছিল। সে আবহাওয়া একেবারে পাল্টে দিল ২১ ফেব্রুয়ারি। মনের জগতে নতুন হাওয়া। নতুন উদ্দীপনা। তবে দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে অনেক দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল।
বরিশালে গ্রেফতার হয়েছিলেন অগ্নিযুগের বিপ্লবী দেবেন ঘোষ। তাঁর সাথে গ্রেফতার হয়েছিলেন তার বড় ভাইয়ের ছেলে দেবকুমার ঘোষ, যিনি মনা ঘোষ নামেই বিশেষ পরিচিত। গ্রেফতার হয়েছিলেন বরিশালের বাণীপীঠ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রেমাংশু সেনগুপ্ত।
দেবেনদা অর্থাৎ দেবেন ঘোষ এবং মনাদার সাথে আমার সম্পর্ক কলেজ জীবন থেকে। এরা দুজনেই এককালে অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁরা আরএসপি গঠন করেন। দেশ ভাগ হবার পূর্ব মুহূর্তে জয়প্রকাশের নেতৃত্বে সোস্যালিস্ট পার্টিতে তারা যোগ দেন।
আমি কলেজ জীবনে আরএসপি’র সংস্পর্শে আসি। দীর্ঘদিন বরিশালে দেবেন দা-দের বাসায় থেকেছি। আমি মোজাম্মেল দা-সহ (মোজাম্মেল হক) অনেকেই দেবেন দা-দের বরিশালের কাউনিয়ার বাসায় ছিলাম। বাসাটি ছিল রাজনীতিকদের হোটেল। কে কখন আসত, কে কখন খেত, কে কখন ঘুমাত তার কোনো হিসাব ছিল না। দেবেনদার বৌদি অর্থাৎ মনাদার মা সব কিছু দেখাশোনা করতেন। বরিশালের ঐ একটিমাত্র বাসায় কোনো জাত-পাতের বিচার ছিল না।
মনাদা ছিলেন সাদাসিদে। ঘোরপ্যাঁচ বুঝতেন না। তত্ত্বের বেশি ধার ধারতেন না। মেঝ কাকা অর্থাৎ দেবেন ঘোষ যা বলবেন তাই শিরোধার্য। তবে এই সাদাসিদে মানুষটির আর একটি রূপ ছিল। অস্ত্র চালনায় তিনি ছিলেন দক্ষ। অনুশীলন সমিতি গড়ে উঠেছিল কতগুলো ক্লাবকে কেন্দ্র করে। দৈহিক কসরত থেকে শুরু করে লাঠি খেলা, ছোরা খেলা সবকিছুর প্রশিক্ষণ দেয়া হতো এই ক্লাবে। এই কাউনিয়া ক্লাব থেকে এককালে মনাদাকে পাঠানো হয়েছিল বিহারে সদাকৎ আশ্রমে। এই আশ্রমে মনাদা অস্ত্রচালনা শিক্ষা দিতেন। ব্রিটিশ আমলে মনাদা ও দেবেন দা দীর্ঘদিন জেল খেটেছেন। দেবেন দা অভিযুক্ত হয়েছিলেন বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলায়। অনেকে বলেন, দেবেন দা’র পরিবার বরিশালের নাজিরপুরের উত্তরে বিস্তীর্ণ এলাকার জমির মালিক ছিলেন। বরিশালে তাদের দুটি কাটা কাপড়ের দোকান ছিল। একটির পর একটি মামলা মোকাবেলা করতে গিয়ে তাদের সবকিছু বিক্রি করতে হয়েছে। গল্পের মতো প্রচারিত আছে, বরিশাল সদর হাসপাতালের অনেকগুলো পেইং ওয়ার্ড যাদের নামে প্রতিষ্ঠিত সেই দাতারা টাকা রোজগার করেছিলেন দেবেন দা-দের বিরুদ্ধে আইনজীবী হিসেবে ব্রিটিশ পক্ষের উকিল হয়ে। শেষ জীবনে তাঁদের অনুতাপ হয়। তাই ঐ মামলায় আয় করা টাকা তারা হাসপাতালে দান করেন।