অথচ শেখ সাহেবের সঙ্গে ইউনিয়নের ভিন্ন ধরনের কথা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন রাজনৈতিক পরিচয় নয়, বেকার সাংবাদিক পরিচয়ে সকলকে চাকরি দেয়া হবে। এখানে ভয় শঙ্কার কোনো কারণ নেই। আর নব্য বাকশালীরা বলতে শুরু করল, বাকশালে যোগ না দিলে চাকরি হবে না। এরা ইউনিয়নকে রাজনৈতিক দলের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার ষড়যন্ত্র শুরু করল।
কিন্তু কেন? বারবার আমি এ কথাটি ভাবতে চেষ্টা করেছি। এ অরাজনৈতিক সাংবাদিকরা কেন হঠাৎ বাকশালের প্রতি অনুরক্ত হলো। কেন হঠাৎ রাজনীতির প্রতি এতো অনুরক্ত হলো। আমার সন্দেহ হলে তাদের নিশ্চয়ই ভিন্ন একটি লক্ষ্য আছে। এ লক্ষ্যটি হচ্ছে আখের গোছানো। নিশ্চয়ই তাদের কোনো মহল থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে, সাংবাদিকদের গরু খেদানোর মতো তাড়িয়ে বাকশালে ঢোকাতে পারলে ভবিষ্যতে পুরস্কৃত করা হবে। তাদের নিশ্চয়ই আশ্বাস দেয়া হয়েছিল, তাদের চাকরির আর অভাব হবে না। প্রয়োজন হলে তাদের ওই পদে নিয়োগ করা হবে। তারা তাদের দালালির পুরস্কার পাবে।
পরবর্তীকালে আমার এ অনুমানই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। বাকশাল গঠনের প্রাথমিক পর্ব শেষ হবার পর শুনেছিলাম এদের অনেককেই তথ্য দফতর ও টেলিভিশনে উচ্চপদ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল এবং ৭২-এর সরকার পরিবর্তনের পর এদের অনেকের প্রতিশ্রুত চাকরি দেয়ার জন্য আমি তদবির করেছি। তথ্য দফতরে কর্মকর্তাদের প্রতিবাদের জন্য এরা তথ্য দফতরে চাকরি পাননি। তবে কেউ কেউ চাকরি পেয়েছিলেন টেলিভিশনে শুষ্ক বিভাগ বা থানায় সার্কেল অফিসার হিসেবে। এদের মধ্যে অনেকেই এখন প্রচুর অর্থের মালিক। সুতরাং যারা সেদিন বাকশালে যোগ দেয়ার জন্য ভীত সাংবাদিকদের বাধ্য করেছিলেন তাদের আদর্শ ছিল ব্যক্তি স্বার্থ, নিজের মঙ্গল ও অন্য কারো মঙ্গল নয়। আবার এদের অনেকেই শেখ সাহেবের মৃত্যুর পর নিজ মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
এখন আবার পূর্বের কথায় ফিরে যাই। বাকশালে যোগ দেয়ার হিড়িকের সময় ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের একটি বৈঠক বসে। এ বৈঠকের আলোচ্যসূচি ছিল বাকশালে যোগদান প্রসঙ্গে। প্রশ্ন উঠেছিল সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্যরা বাকশালে যোগ দেবে কিনা। একদল সাংবাদিক যখন বাকশালে যোগ দেয়ার পক্ষে তখন অন্য সাংবাদিকরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। তাঁরা স্বাভাবিকভাবে ইউনিয়নের কাছে মতামত চান।
কিন্তু এ ব্যাপারে ইউনিয়ন কী সিদ্ধান্ত নেবে? ইউনিয়ন কোনোদিন এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। ইউনিয়নের সদস্যরা বিভিন্ন দলের সদস্য হতে পারে। আর সাংবাদিক ইউনিয়ন কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন নয়। সুতরাং এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার ইউনিয়নের ছিল না। কিন্তু এমন পরিস্থিতিও আমাদের দেশে কোনোদিন সৃষ্টি হয়নি এবং হয়নি বলেই এ পরিস্থিতিতে ইউনিয়নকে বৈঠকে বসতে হয়েছিল।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন বাংলাদেশ সাংবাদিকদের মধ্যে সবচে’ বড় ইউনিয়ন। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নকে ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন। সুতরাং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের মতামত ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কী করার ছিল ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের। তখনো এ ব্যাপারে ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সর্বশেষ বৈঠক বসেনি। কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। এছাড়া কে কোন দলে যোগ দেবে সে ব্যাপারে সাংবাদিক ইউনিয়নে কিছু বলার আছে আমি মনে করি না। কারণ আমিও সাংবাদিক ইউনিয়নের মতামত নিয়ে শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলে যোগ দেইনি। তবে আমি জানি সেদিনের পরিস্থিতিতে আমার এ বক্তব্য ছিল একান্তই একাডেমিক। সমস্যা এড়িয়ে যাবার কথা।
তবে যদি আমরা বন্ধুরা উৎসাহী হয়ে বাকশালে যোগদানের জন্য সাংবাদিকদের বাধ্য না করতাম তাহলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। অন্যান্য সংগঠনের মতোই সাংবাদিক ইউনিয়নের নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যতদূর সম্ভব কাজ চালিয়ে যেতাম। কিন্তু সংকট সৃষ্টি করেছিল আমাদের সেই স্বার্থপর সুবিধাবাদী বন্ধুরা। নিজের আখের গোছাবার জন্য তারা ইউনিয়ন এবং সমগ্র সাংবাদিক সমাজকে ঠেলে দিয়েছিল নৈরাজ্যের দিকে। এদের ব্যক্তিস্বার্থের যূপকাষ্ঠে বলি হয়েছিল সাংবাদিকরা। কারণ এ সমস্যা শুধু সাংবাদিকদের নয়। বাকশাল গঠনের পর সকল ইউনিয়নকে এ সমস্যায় পড়তে হয়। কিন্তু কোনো ইউনিয়নের সদস্যকে ভয় দেখিয়ে বাকশালে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়নি। তাদের কেউ বলেনি, বাকশালে যোগ না দিলে তাদের চাকরি থাকবে না বা তাদের জীবন বিপন্ন হবে। অথচ এ ধরনের একটি প্রচারণা চালানো হয়েছিল সাংবাদিকদের মধ্যে। একটি মহলের ধারণা এই কর্মকাণ্ডের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ইউনিয়নকে ভাঙা। সেদিনের সরকার কখনোই ইউনিয়নের নেতৃত্ব মেনে নেয়নি। সরকারি মহল থেকে বলা হতো দেশে দুটি সরকার চালু আছে-একটি গণভবনে, অপরটি প্রেস ক্লাবে। গণভবনের কোনো নির্দেশই প্রেসক্লাব অর্থাৎ সাংবাদিক ইউনিয়ন মানে না। প্রতিরোধ করে। এ মহলের আশঙ্কা সাংবাদিক ইউনিয়ন হয়তো বাকশাল মানবে না। সাংবাদিক ইউনিয়ন বাকশাল না মানলে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। এই হিসাব থেকে সেকালের সরকার প্রথমেই সাংবাদিক ইউনিয়নকে আঘাত করেছিল। তারা মনে করেছিল সাংবাদিক ইউনিয়ন বাকশাল মেনে নিলে প্রতিরোধ বা প্রতিবাদ করার কেউ থাকবে না। কারণ ইতোমধ্যে কেউ প্রকাশ্যে বাকশাল গঠনের বিরোধিতা করেনি। সকল রাজনৈতিক দল ছাত্র, কৃষক, মহিলা সংগঠন ভেঙে দেয়া হয়েছে বাকশালের মাধ্যমে। একমাত্র বাকি সাংবাদিক ইউনিয়ন। সাংবাদিক ইউনিয়নকে শায়েস্তা করতে পারলে প্রকাশ্যে প্রতিরোধ করার মতো আর কেউ এ দেশে থাকবে না। আমারও ধারণা এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়া তখন সাংবাদিক ইউনিয়ন ভাঙার জন্য ন্যক্কারজনক উদ্যোগ নেবার কোনো কারণ ছিল না। তারা বুঝতে চেষ্টা করেননি যে এ ধরনের ছলে-বলে-কৌশলে ছাগল-ভেড়ার মতো সাংবাদিকদের ধরে কোনো দলে ঢোকালে সে দল আদৌ সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পারবে না। এ পরিস্থিতিতে সেদিন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাকশালে যোগ না দেয়ার। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত কাজে আসেনি।