এছাড়া বাকশালে যোগদানকারী অন্য দলের সঙ্গেও যে তেমন আলাপ আলোচনা ছিল শেখ সাহেবের তা আমার মনে হচ্ছিল না। নিজের তত্ত্বের গরজে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি বাকশালের গেলেও বাকশাল গঠনে যে তাদের তেমন কোনো ভূমিকা ছিল তাও মনে হচ্ছিল না।
ঠিক এ সময় একদিন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (আজকের হোটেল রূপসী বাংলা) একদিন একটি পাটিতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মনি সিং অর্থাৎ মনিদার সঙ্গে দেখা। তিনি আমাকে আদর করে নির্মল দা ডাকতেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী হচ্ছে বলতে পারেন? চেষ্টা করে সংবাদ পত্রিকাটি কি রক্ষা করা যায় না?
আগে উল্লেখ করেছি সরকারি সিদ্ধান্ত হচ্ছে দেশে মাত্র চারটি সংবাদপত্র থাকবে (ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, অবজারভার, বাংলাদেশ টাইমস)। অন্যান্য সকল পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হবে। বন্ধ হবে দীর্ঘদিনের প্রগতিশীল পত্রিকা দৈনিক সংবাদ।
মনি দার কথায় আমি হতভম্ব। আমি বাকশাল বিরোধী। আমার সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। অন্যদিকে সকলের ধারণা কমিউনিস্ট পার্টি বাকশাল গঠনের অন্যতম উদ্যোগী। অথচ মনি দা এ আবেদন আমাকে করছেন। ব্যাপারটা কী? আমি বললাম, মনি দা, বাকশালের তত্ত্ব আপনাদের। এ তত্ত্ব দেশে দেশে অগণতান্ত্রিক পন্থায় সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর জন্যে আপনাদের জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের তত্ত্ব। আপনাদের তত্তে পত্রিকা বন্ধ হচ্ছে। বিপদে পড়েছি আমরা। আর আপনি আমাকে সংবাদ পত্রিকা বাঁচার কথা বলছেন। আপনারা শেখ সাহেবকে বলতে পারেন। একটি পত্রিকা বাঁচলেও আমরা উপকৃত হয়। মনি দা বললেন, দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। চেষ্টা করেও সাক্ষাৎ পাচ্ছি না।
মনি দা’র সঙ্গে আমার কথা শেষ হলো না। অসংখ্য আওয়ামী লীগ নেতা আমাকে ঘিরে ধরলেন। তাদের প্রশ্ন, আপনি জানেন কী হতে যাচ্ছে। কবে আপনার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দেখা হয়েছে। আপনার সঙ্গে নিশ্চয়ই কথা হয়েছে। আপনি জানেন না এমন কিছু হতে পারে না।
আমি অবাক হলাম। সকলের ধারণা আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ। তাই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। আমি দৈনিক বাংলায় অনিকেত ছদ্মনামে কড়া কড়া কথা লিখতাম। তাই নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার আলোচনা হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, একমাত্র এনায়েতুল্লাহ খান ও আমি বাদে তখন সকল কলামিস্টরা তাদের লেখা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখত এবং সে থেকেই ধারণা হতো, আমাকে নিশ্চয়ই শেখ সাহেব সব কিছু বলেন এবং আমার সঙ্গে সব আলোচনা করেন। অথচ আমার সঙ্গে কোনোদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কোনো আলাপ হয়নি। যেমন হয়নি প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। শুধু সকলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার দুর্নাম বা সুনাম নিয়ে আমি সাংবাদিকতা ও রাজনীতি করছি। সেদিন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মনি দা এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার ফলে মনে হলো দেশ একটি গভীর সঙ্কটের দিকে এগোচ্ছে। দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সকলের আশঙ্কা আছে। কিন্তু কেউ কিছু জানে না। বাকশাল বিরোধিরা ভাবছে এবার সব শেষ। দীর্ঘদিনের রাজনীতি আর করা হলো না। তাই বাকশালপন্থীরাও জানেন না কী হবে, কী হতে পারে। ফলে এক শ্রেণির শিক্ষিত মানুষ বাকশালে যাচ্ছে, যাবার প্রশ্নে প্রথম সারিতে থেকে কিছু সুযোগ সুবিধা পাবার জন্যে। অপর দল যাচ্ছে চাকরির ভয়ে, জীবনের ভয়ে, সম্মানের ভয়ে। সে কী এক মর্মান্তিক জ্বালা! এক অসহনীয় অপমানজনক পরিবেশ।
বাকশালে যোগদানের জন্যে সাংবাদিকদের মধ্যে প্রচারণা তখন তুঙ্গে। বাকশাল একটি রাজনৈতিক দল। এ দলে যোগ দিতে হবে। এটাই ছিল এ প্রচারকদের বক্তব্য। অথচ এ সাংবাদিকরা একসময় আমার সমালোচনা করত, আমি রাজনীতি করি বলে। এরা বলত ইউনিয়ন হবে দল নিরপেক্ষ। ইউনিয়ন কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করবে না। সেকালের পরিবেশে আমিও এ নীতি অনুসরণ করতাম। আমি যতদিন ইউনিয়নের সভাপতি ছিলাম ততদিন দলের কোনো সভা সমাবেশে বক্তৃতা দেইনি, দলের পরিচয়ে কোথাও প্রতিনিধিত্ব করিনি।
আমি শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। আমি সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা বলে দলের নামে কোনোদিন কোথাও একটি বিবৃতি পর্যন্ত দেইনি। সাংবাদিক মহল এ জন্য খুশি ছিল। আমি আমার দলের জন্য কখনো সাংবাদিক ইউনিয়নের পদটি ব্যবহার করিনি। আমি শেষ দিন পর্যন্ত এই নীতি অনুসরণ করেছি।
কিন্তু বাকশাল গঠন করার পর লক্ষ করলাম একদল অতি উৎসাহী বাকশালপন্থী সৃষ্টি হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে এরা অনেকেই আওয়ামী লীগের সমর্থক নয়। এদের মুখে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভূমিকা নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি আছে। কিছুদিন আগেও এরা ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে বাঘাবাঘা কথা বলেছে। তাদের কথা ছিল কিছুতেই ইউনিয়নে রাজনীতি আনতে দেবে না। দেয়া হবে না।
হঠাৎ করে পট পরিবর্তন হয়ে গেল। এরা বাকশালী হয়ে গেলেন। সাংবাদিকদের বাকশালে যোগ দেয়াতে চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করলেন। ভয় দেখাতে লাগলেন। বলতে শুরু করলেন–বাকশালে যোগ না দিলে চাকরি থাকবে না। কারণ চারটি দৈনিক ব্যতীত অন্যান্য সকল দৈনিক বন্ধ হয়ে যাবে। শত শত সাংবাদিক বেকার হয়ে যাবে। তাই তাদের কথায় অনেক সাংবাদিক ভয় পেলেন। বিভ্রান্ত হলেন। বাকশালে যোগ দিতে রাজি হলেন।