স্টিমারের সামনের দিকে অনেক ছেলেমেয়ের ভিড়। শেখ সাহেব তার স্ত্রীকে ডাকলেন। বললেন, রেনু তোমার কুটুম এসেছে। শেখ সাহেবের স্ত্রী এলেন এবং শেখ সাহেব বললেন, তোমার কুটুম আমার বিরুদ্ধে কাগজে লেখে। তার লেখা বন্ধ করে দিয়েছি। আমি বললাম, প্রধানমন্ত্রী হলে আমিও এরকম লেখা বন্ধ করে দিতে পারতাম। হঠাৎ শেখ সাহেবের স্ত্রী মুখ খুললেন। বললেন, উনি তোমার বিরুদ্ধে তো লেখেন। এ পরিবারের মানুষ তোমার বিরুদ্ধে লিখলে তোমার পক্ষে কি কেউ নেই দেশে? আমরা দুজনই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। দূরে দেখলাম সাধারণ একজন গ্রামের মানুষের মতো গাজী গোলাম মোস্তফা কাজ করছেন। একেবারে ঘরের মানুষ। তার কোনো বিকল্প নেই। সেদিন এ দৃশ্য না দেখলে এ মানুষটির জীবনের ভিন্ন রূপটি দেখা হতো না। আমি আর খেলাম না। বিকেলে হেলিকপ্টারে ঢাকা ফিরলাম। বাড়ি যাবার সকল প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন হেলিকপ্টারের কমান্ডার ছিল এক প্রিয় ছাত্র। তাকে বললাম, আমাদের বাড়ির উপর একটু দাঁড়াবি। বাড়ি যাওয়া আর হলো না।
সব দল ভেঙে দিয়ে একটি দল বাকশাল গঠন, সকল বৈধ রাজনৈতিক দলকে আত্মগোপন করতে বাধ্য করা এবং আমাদের সাংবাদিকদের বাকশালে যোগদানে বাধ্য করার জন্য অভিযান–কোনোটাই আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হলো না। মনে হতো সারাদেশে একটি অস্বস্তি। কোথায় যেন একটা গোলমাল আছে।
এ গোলমাল বিস্ফোরিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঢাকা সফরকালে। ভুট্টোর ঢাকা সফর নিয়ে মন্ত্রিসভা একমত ছিল না। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত। সকলকেই বলা হয়েছে ১৯৭১ সালের গণহত্যার মূল নায়ক ভুট্টো। ভুট্টোর যা বাসনা ছিল পাকিস্তানে তা সম্ভব ছিল না। তিনি তাই ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য বছরে দুমাসের প্রধানমন্ত্রী পূর্ব পাকিস্তানের এবং বাকি দু’মাসের প্রধানমন্ত্রী পূর্ব পাকিস্তানে দেবার প্রয়াস নিয়েছিলেন। এ প্রস্তাব কেউ গ্রাহ্য করেনি। তাই ভুট্টোর পাকিস্তানের একচ্ছত্র নেতা হবার জন্যে পাকিস্তান ভাঙার প্রয়োজন ছিল। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভুট্টো ছিল ১৯৭১ সালের গণহত্যার সবচে বড় নায়ক। সেই ভুট্টো পরে ভাঙা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সেই ভুট্টো বাংলাদেশে আসুক তা জনগণের কাছে কাম্য ছিল না।
কিন্তু শেখ সাহেব ভেবেছিলেন অন্যভাবে। তিনি পাকিস্তান থেকে ফিরে দেখলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও পাকিস্তানসহ মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ বা চীনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে ভারতের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশকে বাঁচতে হচ্ছে। তিনি চাইলেন ভারসাম্য বিধানের জন্যে এবং কাজ শুরু হলো ইসলামি সম্মেলনে যোগদান এবং ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণের মধ্যদিয়ে। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের ইসলামি সম্মেলনে যোগদান মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ভালো লাগেনি। পরবর্তীকালে ভুট্টোকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ নতুন প্রশ্নের জন্ম দিতে থাকে। তাহলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান কী চান। তিনি কি ভাবতে পারছেন না, ভুট্টো এদেশে এলে কী প্রতিক্রিয়া হবে।
আমার ধারণা শেখ সাহেব ভেবেছিলেন তার নেতৃত্বে মুগ্ধ বাঙালি সবই মেনে নেবে। ভুট্টো নির্বিঘ্নে বাংলাদেশ সফর করে যাবেন এবং পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তিনি সাফল্য লাভ করবেন। পাকিস্তানসহ মুসলিম দেশসমূহের স্বীকৃতি পাওয়া সহজ হবে। কিন্তু ঘটনা সে রকম ঘটল না। ভুট্টোর সফরকালে প্রমাণ হলো সেদিনের বাংলাদেশের একটি বিরাট জনগোষ্ঠীর কাছে পাকিস্তান ভাঙা কাম্য ছিল না। এরা ইয়াহিয়াকে চায়নি।
এরা গণহত্যার বিরোধী। কিন্তু পাকিস্তান থাকুক, ক্ষমতা পরিবর্তন হোক–এটাই চেয়েছে। এরা হাজারে হাজারে রাজপথে নামল ভুট্টোকে সংবর্ধনা জানাতে। বিমানবন্দর থেকে ফিরতি পথে এরা ভারতীয় হাইকমিশনারের গাড়ি থেকে ভারতীয় পতাকা ছিনিয়ে নিল। ভুট্টোকে অভিনন্দন জানাল পাকিস্তানের পক্ষে স্লোগান দিয়ে। ফলে ভুট্টো ফিরে যাবার দিন জনতা ঠেকাতে বাংলাদেশ সরকারকে রাজপথে পুলিশ নামাতে হয়েছে। জনতা ঠেকাতে কাঁদানে গ্যাস, লাঠিচার্জ করতে হয়েছে।
আমার কাছে এ ঘটনা অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু এ বাস্তবতা আদৌ গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। মনে হয়েছে কোনো কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আর এ মুহূর্তে দেশে সরকার একদল গঠন করে সকল জনমত বন্ধ করতে যাচ্ছে। দেশে মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ। তারপর নিষিদ্ধ হলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতির একটি অংশ বাকশালের নামে। কারণ বাকশালে যোগদানকারী ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং একতা পার্টি ব্যতীত অনেক পার্টি এবং গ্রুপ ছিল যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে। কিন্তু বাকশালে যোগ দেয়নি।
আমার কাছে পরিষ্কার ছিল না কেন শেখ সাহেব এ পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এমনিতে মন্ত্রিসভা থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রধান নেতা তাজউদ্দীন আহমদকে বের করে দেয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান শক্তি ছাত্রলীগ বিভক্ত এবং এদের সংগ্রামী অংশটি তখন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ নামে বিরোধী শিবিরে। অথচ পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং চিহ্নিত পাকিস্তানপন্থী আমলাদের পুনর্বাসিত করা হচ্ছে। মুখে বলা হচ্ছে সমাজতন্ত্র এবং প্রগতির কথা।