আমার দলের মতে, এ ছিল ভুল, মহাভুল। লেনিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিনের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে যে ভুল শুরু হয়েছিল এ হচ্ছে তার শেষ পরিণতি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর লাল ফৌজের সহায়তায় পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট পার্টিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে যেন বলা হয়েছিল জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছে। এবার শান্তিপূর্ণভাবেই সমাজতন্ত্রে উত্তরণ হবে। শেষ পর্যন্ত ওই একই অগণতান্ত্রিক পন্থায় সমাজতন্ত্রে পৌঁছবার দাওয়াই দেয়। তার ফসল বাকশাল। আমাদের মতে, বাংলাদেশে সনাতন ধারার কোনো বুর্জোয়া শ্রেণি গড়ে ওঠেনি। এদের কোনো দলীয় শ্রেণি চরিত্র নেই। এরা মুখ্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল। সঙ্কটকালে এরা সাম্রাজ্যবাদের আশ্রয় নেবে। এদের কাছে বাকশাল ছিল সমাজতন্ত্রের লেবেল। এ লেবেল এটে বামপন্থীদের ভাওতা দিয়ে একদলীয় শাসন কায়েম করা। জনতার রোষ থেকে বেঁচে যাওয়া। একই সঙ্গে অন্যান্য দল ভেঙে দেবার অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করা এবং এ কথা প্রমাণিত, কমিউনিস্ট পার্টি ন্যাপ, একটা পার্টি ভেঙে যাওয়ায় সেদিনের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের কোনো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ছিল না। তখন মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক দলগুলো ছিল নিষিদ্ধ। ফলে বাকশাল হয়ে উঠবে একটি একদলীয় শাসনের স্টিম রোলার। জনগণের আন্দোলন বিপর্যস্ত হবে। এটাই ছিল আমাদের ধারণা। তাই আমার ব্যক্তি বা পরিবারের সম্পর্কের জন্যে শেখ সাহেবের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো থাকবে, এ বিশ্বাস ঠিক ছিল না। তবু শেখ সাহেব নাকি আমার সম্পর্কে বলেছেন, নির্মল সেন একটি আদর্শবাদী রাজনীতি করে। সে বাকশালে আসবে না। তাই ওকে এ অনুরোধ কেউ করবেন না। এ আমার শোনা কথা। তাই আমার কাছে স্পষ্ট ছিল আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নয়, একেবারে রাজনৈতিক। আমার পক্ষে পত্রিকা বাঁচানো সম্ভব নয়। পত্রিকা থাকবে কি থাকবে না তা হবে দলীয় সিদ্ধান্ত। একটি দলীয় সরকারের শাসনে একদলীয় মুখপত্র থাকে। বহুদলীয় পত্রিকা থাকতে পারে না। অথচ আমাদের ইউনিয়নের মুখ্য লক্ষ্য হচ্ছে বহুদলীয় ধারাকে বাঁচিয়ে রাখা। তাই এখানে সমঝোতার অবকাশ কোথায়!
এছাড়া তখন লক্ষ্য করেছিলাম আমার সাথে শেখ সাহেবের বনিবনা হচ্ছে না। তিনি আগে কথা শুনতেন। কিন্তু এখন দেখছি কথা শুরু হলেই তিনি উগ্র হয়ে যান। এর একটা কারণ হলো আমার লেখালেখি, কাউকে তোয়াক্কা না করার ভাব এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সকল দলের সঙ্গে মতানৈক্য। কারণ আমি সমাজবাদে বিশ্বাসী হলেও মস্কোপন্থী এবং পিকিং দু’দলকে ভুল বলে মনে করতাম। মনে করতাম আমাদের দেশে মস্কোপন্থী পিকিংপন্থীরা নির্ভেজাল মস্কো-পিকিংর দালালি করছে। সমাজের বারোটা বাজাচ্ছে। ফলে বাম রাজনীতির ক্ষেত্রেও তেমন কোনো বন্ধু ছিল না। এক সময় শিল্প এলাকায় আমাদের প্রবল প্রতাপ ছিল। তাও ভেঙেচুড়ে প্রায় নিঃশেষ আওয়ামী লীগ আমলে। তাই রাজনীতির ক্ষেত্রে আমার প্রায় একক। হাতে একটি কলম, মুখে তীক্ষ্ণ কথা এবং বাকশাল গঠনের প্রাক্কালে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাই আমার পক্ষে আসছিল না।
মাঝখানে শেখ সাহেবের বাবা শেখ লুত্যর রহমান মারা গেলেন। সন্ধ্যার দিকে আমি ও গিয়াস কামাল শেখ সাহেবের বাসায় গেলাম। চারদিকে অনেক লোক। শেখ সাহেবের কাছে দাঁড়ানো তাজউদ্দীন আহমদ, কোরবান আলীসহ অনেক নেতা। শেখ সাহেব কাঁদছিলেন। দূরে আমাকে দেখে গিয়াস কামালকে ডেকে বললেন, নির্মল সেনকে ডেকে নিয়ে আয়। আমাকে বললেন, দেখি এবার নির্মল সেনকে কে বাঁচায়। মা মারা গেছে আগে, এবার বাবা গেলেন। এবার নির্মল সেন বুঝবে শেখ মুজিবুর রহমান কে এবং কেমন। আমি বললাম–তা পরে দেখতে পাবেন, আপনি আজ একি বলছেন? কাছাকাছি সকলে অবাক বিস্ময়ে চুপচাপ। কারণ এদের কারোরই আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক জানার কথা নয়। এবার শেখ সাহেব কথা ঘোরালেন। বললেন, বাবার লাশের সঙ্গে টুঙ্গীপাড়া যাবেন। মার লাশের সঙ্গে যাননি। এবার যেন ভুল না হয়। শেষ পর্যন্ত আমার লাশের সঙ্গে যাওয়া হয়নি।
চেহলামের দিন টুঙ্গীপাড়ায় গেলাম। সঙ্গে সেনাবাহিনীর তিন প্রধান, হুইপ আব্দুস সামাদ আজাদ ও তাহের উদ্দীন ঠাকুর। শেখ সাহেব আমাকে দেখে ফরিদপুরের ডিসি মোহাম্মদ আলীকে ডাকলেন–বললেন, একটা স্পিড বোট ঠিক করেন, নির্মল সেন কোটালীপাড়া যাবে। আমি বললাম, আমি আপনার স্পিড বোটে যাব না। হেলিকপ্টারে টুঙ্গীপাড়ায় এসেছি তাতেই প্রেস ক্লাবে কথা শুনতে হবে। আমি ঢাকা ফিরে যাব। শেখ সাহেব চুপ করে গেলেন। তিনি বসে আছেন গাজী স্টিমারে। সঙ্গে খন্দকার মোশতাক, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, কোরবান আলী এবং অনেকে। ফনি বাবু বললেন, তিনি স্পিড বোটে মাদারীপুরে যাবেন। এর মধ্যে হঠাৎ যেন শেখ সাহেব গর্জে উঠলেন-তাহের ঠাকুর, তুই কোন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী। তুই মোশতাকের সঙ্গে ঘুরিস কেন। তোরে আমি ঠ্যাং পিটিয়ে ভেঙে দেব। তাহের ঠাকুর বললেন, বঙ্গবন্ধু, আমি কুমিল্লার লোক তাই। শেখ সাহেব বললেন, থাম, তুই তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, মনে থাকে যেন। সমস্ত পরিবেশটা একটু হোঁচট খেল। এর মধ্যেই কথা বললেন খোন্দকার মোশতাক। বললেন, ঠাকুর মনে থাকে যেন তুমি এক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী। শেখ সাহেব আমাকে লক্ষ করে বললেন, চলুন বাইরে যাই। আপনি তো সবাইকে চেনেন। আমরা দুজনেই বের হলাম।