বাকশাল গঠনের পর মুখ্য হয়ে উঠলো সংবাদপত্রের কথা। দেশে মাত্র ৪টি সংবাদপত্র থাকবে। হাজার হাজার সাংবাদিক কর্মচারী চাকরি হারাবে। ‘ এটাই বড় হয়ে দেখা দিল এবং সকলের মুখে একই কথা, দেখি না সাংবাদিকরা কত দূর যায়। অথচ কেউ প্রশ্ন করল না, দেশে একদলীয় শাসন হচ্ছে। রাজনৈতিক দল ভেঙে দেয়া হচ্ছে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের যুগ শেষ হচ্ছে। অথচ কোনো রাজনৈতিক দলই মাঠে নামছে না। এমনকি মওলানা ভাসানী পর্যন্ত একটি হুঙ্কার দিচ্ছেন না। কেন? তিনি ডাকলে তো অনেক কিছু হয়। সেই রাজনীতিকরা টু-শব্দটি করলেন না। সকল প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো সাংবাদিক ইউনিয়নকে।
এই পরিস্থিতিতে দেশের প্রেসিডেন্ট ও বাকশালের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি ইউনিয়ন নেতাদের সাথে কথা বলবেন। আমার সাথে তখন শেখ সাহেবের সম্পর্ক ভালো নয়। তবু আমাকে যেতে হবে। বন্ধুরা বললেন–আপনি কোনো কথা বলবেন না। সব কথাই আমরা বলব। আপনি কথা বললে শেখ সাহেব ক্ষিপ্ত হয়ে যান। কোনো আলোচনাই এগোয় না। এবার আপনি কোনো কথা বলবেন না।
কিন্তু ঘটনা সেখানে ঘটল না। আমি নতুন গণভবনে ঢুকতেই শেখ সাহেব বললেন, কেমন আছেন, প্রেসিডেন্ট সাহেব? আমার পাশেই বসুন। আমি তার পাশে বসলাম। শেখ সাহেব তাঁর কথা শুরু করলেন। তিনি বললেন, বাকশাল গঠন করেছি। ৪টি পত্রিকা থাকবে। পরবর্তীকালে আরো দুটি পত্রিকা বের করা হবে। কিন্তু সাপ্তাহিক ও মাসিক থাকবে। এসব হবে বিনোদনমূলক কাগজ। চাকরিচ্যুত সাংবাদিক ও কর্মচারীরা নতুন চাকরি পাবে। যতদিন তারা চাকরি না পায় ততদিন তাদের মূল বেতনের সমপরিমাণ টাকা সরকার দিয়ে যাবে। তাদের চাকরির ধারাবাহিকতা ও মূল বেতন সংরক্ষণ করা হবে। আপনাদের কাউকে আমি কর্মচ্যুত করতে চাই না।
আমরা চুপ করে শেখ সাহেবের কথা শুনছিলাম। আমার বন্ধুরাও চুপ। আমার সাথে ছিলেন গিয়াস কামাল চৌধুরী, কামাল লোহানী ও রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ। শেখ সাহেব আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, কোনো কথা বলছেন না কেন। আমি বললাম–আমার বলার কিছু নেই। আমি বিএফইউজের সভা ডাকব। এ সভায় কী সিদ্ধান্ত হয় তা আপনাকে জানাব। ব্যক্তিগতভাবে আমার বলার কিছু নেই। আমার কথার প্রতিক্রিয়া হলো। শেখ সাহেব তীব্র কণ্ঠে বললেন–এ দেশে কোনো ইউনিয়ন-টিউনিয়ন নেই। সব বাতিল হয়ে গেছে। আপনাদের ডেকেছি সমস্যা সমাধানের জন্যে। অন্য কিছু বলার অবকাশ নেই। আমি বললাম, আমি যা বলেছি তারচে’ বেশি কিছু বলতে পারব না। শেখ সাহেব বললেন, ঠিক আছে, মিটিং করুন। কিন্তু সংবাদপত্রে কোনো বিজ্ঞপ্তি যাবে না। এ কথা যেন মনে থাকে।
বৈঠক শেষ হলো। ফেরার পথে শেখ সাহেবের সচিব আবদুর রহিমের সাথে দেখা হলো। তিনি বললেন, দাদা এটা আপনি কী করলেন? কোনো প্রতিবাদ না করে বঙ্গবন্ধুর কথা মেনে নিলেন? ভোরবেলা থেকে তিনি বড় বিচলিত ছিলেন। তিনি বারবার বলেছেন, আমি সকলকে মানাতে পারব। নির্মল সেনকে মানাতে পারব না। নির্মল সেন বাকশাল মানবে না। পত্রিকাও বন্ধু হতে দেবে না। সে ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। তাকে নিয়ে কী করব। এই বলে রহিম সাহেব কিছুটা থামলেন। বললেন, কাজটা আপনি ভালো করেননি। আপনিই একমাত্র পত্রিকা বন্ধ ঠেকাতে পারতেন। আমি এর কোনো জবাব না দিয়ে নতুন গণভবন থেকে চলে এলাম।
প্রেস ক্লাবে ফিরে দেখি প্রায় একই পরিস্থিতি। বিদেশি সাংবাদিকরা বসে আছে। সব কথা শুনে তারা বললেন–নির্মল সেন, আপনি ভুল করেছেন। আপনি স্ট্যান্ড নিলে পত্রিকাগুলো বাঁচত। প্রয়োজন হলে আপনি আজই ঘোষণা দিয়ে আমরণ অনশন করুন। সরকার আপনার কথা শুনবে।
আমি বললাম–আপনারা বিচ্ছিন্নভাবে শুধু পত্রিকার কথা ভাবলেন। বাকশাল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও আদর্শ। রাজনীতিকরাই বাকশাল ঠেকাতে পারে। সেই রাজনৈতিক শক্তি আমার নেই। আমি রাজনীতি করি। তাই ব্যক্তিগত অহমিকায় ভুগে কোনো একক সিদ্ধান্ত নেব না। যৌথভাবে ইউনিয়ন যে সিদ্ধান্ত নেয় সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করব। আমি শেখ সাহেবকে কোনো কথা দিয়ে আসিনি। আসছে সপ্তাহ চট্টগ্রাম ইউনিয়নের বৈঠক বসবে। সেই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না।
আমার সাথে শেখ সাহেবের সম্পর্কের অবনতি ঘটায় অনেকের মন খারাপ। তাদের ধারণা ছিল হয়তো আমি কিছু একটা করতে পারব। কিন্তু এমন বিশ্বাস আমার কোনোদিন ছিল না। শেখ সাহেব আমার অনেক কথা শুনেছেন। কিন্তু বাকশালের ব্যাপারে আমার কথা শুনবার কোনো অবকাশ নেই। বাকশাল একটি রাজনৈতিক দর্শন। এ দর্শনের মূল কথা হচ্ছে অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সমাজতন্ত্রে পৌঁছানো। এ দর্শন সোভিয়েত ইউনিয়নের তাত্ত্বিক উলিয়ানভের।
এ দর্শনের মূল কথা যে সকল দেশে শিল্প বিপ্লব হয়নি বা জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব হয়নি, সে সকল দেশে জাতীয় বুর্জোয়াদের সহযোগিতায় করতে হবে। শিল্প না হওয়ায় শ্রমিক নেতৃত্ব দুর্বল। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো এ দেশে বিপ্লব হবে না। এ জন্যে বলা হয় যে, জাতীয় বুর্জোয়াদের এখনো একটি বিপ্লবী ভূমিকা আছে। তাই প্রগতিশীল শ্রেণির দলের কাজ হবে জাতীয় বুর্জোয়াদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমাজতন্ত্রের পক্ষে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পাদন করা। এ রাজনীতি তকালীন কমিউনিস্ট পার্টি তানজানিয়া, সোমালিয়ায় এ বিপ্লব করেছে এবং শেষ পর্যন্ত এ বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে ইথিওপিয়ায়। এ তত্ত্ব অনুযায়ী রাজনীতির ধরন হচ্ছে একদলীয় গণতন্ত্র। সম্পন্ন হয়েছে ইথিওপিয়ায়। এ তত্ত্ব অনুযায়ী রাজনীতির ধরন হচ্ছে একদলীয় গণতন্ত্র। প্রগতিশীল শ্রেণির সহযোগিতায় দক্ষ একটি রাজনৈতিক, শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্র সংস্থা গড়ে তোলা। তার ভিত্তিতে সেকালে বাকশাল গঠিত হয়েছিল। সেকালে এ তত্ত্বের সমর্থনে মোজাফফর ন্যাপ তানজানিয়া, সোমালিয়ার অভিযোগের ভিত্তিতে বই ছাপাত এবং আমাদের কাছে বিলি করত।