এ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তিনটি বৃহৎ শক্তি অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধকালীন মৈত্রী হয়। ১৯৪৩ সালে আবার দু’শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে দাবি করে যে, তৃতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙে দিতে হবে। কারণ তৃতীয় আন্তর্জাতিকের নির্দেশে দেশে দেশে কমিউনিস্টরা নাশকতামূলক কাজ চালাচ্ছে। আন্তর্জাতিক চাপে স্ট্যালিনকে রুজভেল্ট ও চার্চিলের প্রস্তাব মেনে নিতে হয়। তৃতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙে দেয়া হয়। যদিও প্রকাশ্যে বলা হয় যে, বিশে কমিউনিস্ট আন্দোলন শক্তিশালী হওয়ায় এখন আর আন্তর্জাতিকের প্রয়োজন নেই। দেশে দেশে কমিউনিস্টরা নিজেরাই আন্দোলন করবে। অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের নিজস্ব প্রয়োজনেই চাপে পড়ে আন্তর্জাতিক ভেঙে দিতে হয়।
কিন্তু কমিউনিস্টদের আন্তর্জাতিকের প্রয়োজন কোনোদিন ফুরায় না। সাম্যবাদী বিশ্ব আন্তুর্জাতিক কোনো দেশের গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ নয়। তাই আবার কমিনফর্মের নামে নয়া আন্তর্জাতিক গড়ে তোলা হয় ১৯৪৭ সালে। সদর দফতর স্থাপিত হয় বেলগ্রেডে। এবার বেলগ্রেড থেকেই অভিযোগ ওঠে যে কমিনফর্মের নামে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার মতামত চাপিয়ে দিচ্ছে। ফলে যুগোশ্লাভকে কমিনফর্ম থেকে বহিষ্কার করা হয়। কমিনফর্ম ভেঙে দেয়া হয় ১৯৫৭ সালে। সেই কমিনফর্মের নির্দেশেই কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৫০ সালে জেলখানার আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করে। আন্তর্জাতিকের নামে স্ট্যালিনের নেতৃত্বে দেশে দেশে চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তের এভাবে শিকার হয় কমিউনিস্ট আন্দোলন। এই কমিনফর্ম-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেলখানায় আন্দোলন স্তিমিত হলো। কিন্তু বাইরে তখন আন্দোলন নতুন করে গতি পাচ্ছে। লিয়াকত আলীর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন খাজা নাজিমুদ্দীন। গভর্নর জেনারেল হলেন আমলা গোলাম মোহাম্মদ। প্রধানমন্ত্রী হয়ে ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকা আসেন। তিনিও মোহাম্মদ আলী জিন্নার ভাষায় কথা বলতে শুরু করেন। পল্টন ময়দানে তিনি এক জনসভায় বললেন- উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হলো পূর্ব বাংলায়। ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট আহ্বান করা হয় ২১ ফেব্রুয়ারি। ৩১ জানুয়ারি ঢাকার বার লাইব্রেরিতে রাজনৈতিক দলসমূহের এক সভা হয়। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন মওলানা ভাসানী। ৪ ফেব্রুয়ারি ১০ হাজার ছাত্র ছাত্রী ঢাকায় মিছিল করে। ২১ ফেব্রুয়ারি নিয়ে পূর্ব বাংলায় সরকারি মহলে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। তখন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নূরুল আমিন। মুখ্য সচিব অর্থাৎ চিফ সেক্রেটারি ছিলেন জাদরেল পাঞ্জাবি আমলা আজিজ আহম্মদ। বলা হতো আজিজ আহম্মদ-ই ছিলেন তখন পূর্ব বাংলার প্রকৃত শাসনকর্তা। সিদ্ধান্ত হয় ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করার। কিন্তু ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট বিশ্বাসভাজন ছিলেন না। ফলে নারায়ণগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক অবাঙালি কোরেশীকে ঢাকায় রাতারাতি বদলি করে আনা হয়। ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি হয়। সেই ১৪৪ ধারা ভেঙে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল করে।
তবে ১৪৪ ধারা ভাঙা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। বলা হয়, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা ভাঙতে রাজি ছিল না। তারা কোনো বড় ধরনের গোলমালে যেতে রাজি হননি। মুখ্যত ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এ ব্যাপারে কার কী ভূমিকা ছিল তা এখনো অস্পষ্ট। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন অনেকেই ভাষা সৈনিক হবার দাবিদার। এই খেতাব নিয়ে তাঁদের মধ্যে অনেকে এখন সভা সমিতিতে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন। তবে এ সম্মান তাঁরা পাবার যোগ্য কিনা সে প্রশ্নের জবাব তাঁদেরই দেবার কথা। তাঁরা নিজের কথা সঠিকভাবে বললে এ অস্পষ্টতা অনেকটা দূর হতো। এ প্রসঙ্গে শুধু একটি কথাই জোর দিয়ে বলা যায়, সেদিন সাধারণ ছাত্ররা বিশেষ করে মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল।
আমি তখন ঢাকা জেলে। প্রায় বছর চারেক হলো বরিশাল জেল থেকে ঢাকা জেলে এসেছি। জেলা শহরে থাকতাম। রাজধানীর খবর তেমন রাখতাম না। পূর্ব বাংলার খবরের কাগজ একমাত্র দৈনিক আজাদ। এ কাগজটিতেও বিরোধী দলের খবর তেমন থাকত না। তাই খবর পাওয়া ছিল খুব কষ্টকর। অপরদিকে ১৯৫০ সালের দাঙ্গার পর বামপন্থী রাজনীতি একেবারে তছনছ হয়ে গেছে। কে কোথায় আছে তাও দীর্ঘদিন খবর পাইনি। দলের নেতা অনেকেই দেশান্তরী হয়ে গেছেন। এমনকি মোজাম্মেল দা-ও নাকি কলকাতায় চলে গেছেন (মোজাম্মেল হক পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। দৈনিক পাকিস্তান-এর প্রথম বার্তা সম্পাদক–যিনি কায়রোগামী পিআই-এর বিমান দুর্ঘটনায় ১৯৬৫ সালের ২০ মে মারা যান)। আমাদের নেতা অনিল দাশ চৌধুরী, আব্দুল খালেক খান ও ছাত্রনেতা নারায়ণ দাশ শর্মা কোথায় আছেন তাও জানি না। বরিশালের এই তিন নেতা মোজাম্মেল-দাসহ পাকিস্তান সৃষ্টির বছর কয়েকের মধ্যে গ্রেফতার হয়ে যান। আদালত তাদের শাস্তি দেয়। শুনেছিলাম তারা সিলেটে জেলে আছেন। মুক্তি পেয়েছেন কবে তাও জানি না। লোকমুখে শুনেছি ১৯৫০ সালের দাঙ্গার পর মোজাম্মেল দা ও অনিল দা কলকাতায় চলে গেছেন। ভেবেছি হয়তো নারায়ণও চলে গেছে কলকাতায়। জানতাম না খালেক দা কোথায়? খালেক দা-আব্দুল খালেক খান। পরবর্তীকালে সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। খালেক দা মারা গেছেন ২০০২ সালে।