এবার শেখ সাহেব অন্ধকারের দিকে তাকালেন। বললেন, নির্মল সেন সত্যি সত্যি দেশটা গুণ্ডার দেশ হয়ে গেছে। কিছু করতে পারলাম না। আপনি ঠিক বলেছেন, দেশটা হবে গুণ্ডার দেশ। ছোট মামাকে কোলকাতা থেকে না এনে ভালো হয়েছে।
এখানে বলে রাখা ভালো যে, শেখ সাহেবের মা আমার ছোট কাকাকে ভাই ডেকেছিলেন। সেই সুবাদে আমার ছোট কাকা শেখ সাহেবের ছোট মামা। আমার ছোট কাকা ১৯৬৫ সালে কোলকাতা চলে যান। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে শেখ সাহেব বলেছিলেন, ছোট মামাকে নিয়ে আসুন। আমি বলেছিলাম, তাঁকে আনা ঠিক হবে না। দেশটা হবে গুণ্ডার দেশ। কাকা ভারতের নাগরিক। বিপদ হবে।
এরপরে একটি অদ্ভুত কথা বললেন তিনি। বললেন, নির্মল সেন, আপনি আর কামালের মা আমাকে সমর্থন দিলেন না কোনো ব্যাপারে। কিছু করতে পারল না। দিন দিন অন্ধকার গম্ভীর হচ্ছে। আমার কিছু বলার ছিল না। কারণ শেখ সাহেবের পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ঘনিষ্ঠ ছিলাম না। আমি শেখ সাহেবের মৃত্যুর পূর্বে মাত্র দু’দিন তাঁর ৩২ নম্বরের বাসায় গিয়েছি। তবে এ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল ছাত্রজীবনে। আমি গিমাডাঙ্গা-টুঙ্গিপাড়া নিম্নমাধ্যমিক স্কুলে পড়েছি। একই শিক্ষক আমাদের পড়িয়েছেন তবে বিভিন্ন সময়ে। আমরা দু’কাকা ওই এলাকায় পাটগাতীতে ডাক্তারি করতেন।
শেখ সাহেবের সাথে আমাকেও ভাবতে হলো বারবার। সত্যি সত্যি আমি কী করব। বাকশাল গঠিত হতে যাচ্ছে। সকল রাজনৈতিক দল ভেঙে দেয়া হয়েছে। একটি মাত্র রাজনৈতিক দল অর্থাৎ বাকশাল থাকবে। এমনি করে থাকবে জাতীয় ছাত্রলীগ, জাতীয় যুবলীগ, কৃষক লীগ। সর্বত্র আওয়ামী লীগ পন্থীদের খবরদারি। সাথে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও জনতা পার্টি। এদেরও খুব পাত্তা দেয়া হবে বলে আমার ধারণা নেই। আমাদের আর কারো রাজনৈতিক অস্তিত্ব থাকবে
তাহলে আমরা বাঁচব কী করে? আমরা কি আত্মগোপন করব? কিন্তু দল তো সেভাবে গঠিত হয়নি। এমনিতেই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের বিপর্যস্ত অবস্থা।
এই তোপের মুখে কেউ দাঁড়াতে পারছে না। আমি সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা হওয়ায় কিছুটা হালে পানি পাচ্ছি। আমার লেখার জন্যে দেশবাসীর কাছে আমি পরিচিত। সাংবাদিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকায় হয়তো আমার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ইতোমধ্যে তিন মাসের নোটিশে আমাদের দলের পুরনো অফিস থেকে উৎখাত করা হয়েছে। এরপরে সংসদে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সব দল ভেঙে দেয়া হবে। একটি মাত্র দল থাকবে। এই দলের নাম হবে বাকশাল।
এরপরেও আমার একটা বাড়তি অস্তিত্ব আছে। অস্তিত্ব হচ্ছে সাংবাদিক ইউনিয়ন নিয়ে। এই একটি মাত্র ইউনিয়ন দেশ স্বাধীন হবার পর সরকারের কাছে মাথা নত করেনি। কিন্তু এখন কী করবে? সাংবাদিক ইউনিয়ন কোনো জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত নয়। একক এবং স্বাধীন। দেশের আইন মানতে হলে সাংবাদিক ইউনিয়নকে শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। অথচ মরে গেলেও আমরা অনেকেই শ্রমিক লীগে যাব না, সে কথা সবাই জানে।
কিন্তু আমি কিংবা আমরা শ্রমিক লীগে না গেলেও সাংবাদিকদের সমস্যা থাকবে। এ সমস্যা আমি এড়াব কী করে? তাই একমাত্র বিকল্প পথ হচ্ছে বাকশালের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা বা সব কিছু থেকে সরে দাঁড়ানো।
কিন্তু সরে দাঁড়ানো কি সম্ভব? সংবাদপত্রের কয়েক হাজার সাংবাদিক ও কর্মচারী কর্মচ্যুত হবে। তাদের সমস্যার সমাধান কী করে হবে? ভুল করে হোক আর শুদ্ধ করে থোক তখন আমার মতো তিন-চারজন নেতাই সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমার বন্ধুরা আমার ওপর খুবই নির্ভরশীল। আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ। শেখ সাহেবের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। আমি সরকারের কাছ থেকে কোনো সুযোগ-সুবিধা নিইনি। আমি মন্ত্রীদের সাথে মুখে মুখে তর্ক করি। ফলে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল, আমার অধিকাংশ বন্ধুরা আমার ওপর বেশি নির্ভর করত। এ নির্ভরতা আদৌ সঠিক ছিল না।
এছাড়া আমার নিজস্ব একটি রাজনৈতিক দর্শন ছিল। আমি একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য। আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি, বাকশাল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। বাকশাল একটি রাজনৈতিক আদর্শ। বিকল্প রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে বাকশালকে ঠেকানো যাবে না। এ দায়িত্ব না ইউনিয়নের না রাজনীতিকদের।
কিন্তু বাকশাল গঠনের পর লক্ষ করলাম কোনো দলই তেমন কথা বলল না। রাজনৈতিকভাবে কেউ বাকশালের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টাও করল না। মনে হলো সকলেই যেন সাংবাদিক ইউনিয়নের দিকে তাকিয়ে আছে। এ ঐতিহ্য দীর্ঘদিন আগের। পাকিস্তান আমলে বিশেষ কারণে সাংবাদিকদের একটি রাজনৈতিক ভূমিকা ছিল। রাজনৈতিক অঙ্গনে শূন্যতার জন্য সাংবাদিকদের মাঠে নামতে হতো। সেকালে যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম সারিতে থাকত সাংবাদিকরা। সংবাদপত্রের। স্বাধীনতার জন্যে তাদের মুখ্য ভূমিকা নিতে হতো। অথচ মুখ্যত এ দায়িত্ব রাজনৈতিক দলের। কারণ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ব্যাহত হলে দেশবাসী ক্ষন্ত্রিস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল। তাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার আন্দোলন মুখ্যত রাজনীতিকদের। সাংবাদিকরা সেখানে সহায়ক শক্তি। ভারতেও লক্ষ করা গেছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্যে মুখ্যত লড়ছে রাজনৈতিক দল। অপরদিকে পাকিস্তান এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে কোনো কিছু হলেই সাধারণ মানুষ সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাজনীতিকদের দিকে নয়। এ প্রেক্ষিতে বাকশাল গঠনের পর বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলো সাংবাদিক ইউনিয়ন।