ওই সময় সেখানে তল্কালীন সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন আহমদ উপস্থিত ছিলেন। তিনি শেখ সাহেবকে লক্ষ্য করে বললেন, উনি তো ভালো লেখেন। লেখা তুমি কেন বন্ধ করবে? শেখ সাহেব বললেন, জানি ভালো লেখে। আর লিখলে ছ’টি এজেন্সির ফোন আসে। আরো লক্ষ করেছি তার লেখার শেষ দিকে হুল থাকে, যা আমাদের লোকদের কাছে সমস্যা। আমি বললাম, এতে কিছু আসে যায় না। আমার কথা আমি লিখি। মহিউদ্দিন সাহেব আবার মুখ খুললেন। বললেন, দেখুন আমরা বাকশাল গঠন করেছি। আপনি বাকশালের বিরুদ্ধে লিখলে আমাদের পক্ষে অসুবিধা হবে। মানুষ আমাদের চেয়ে আপনাকে বেশি বিশ্বাস করে। তাই আপনার লেখা বন্ধ করা প্রয়োজন কিছুদিনের জন্যে হলেও। আমি বললাম, আমার পক্ষে কোনো অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব নয়। এবার শেখ সাহেব তার পুরানো কৌশল নিলেন। তিনি হাত জোড় করে বললেন–বলুন তো আমি কে?
আমি বললাম, বর্তমানে রাষ্ট্রপতি। পূর্বে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। শেখ সাহেব বললেন, রাষ্ট্রপতির অনুরোধ–আপনি তিন মাসের জন্যে লিখবেন না। আপনি চাকরি করবেন–বেতন নিবেন। এ কথা আপনার সম্পাদকও জানবেন না। আমি বললাম, এটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি ইউনিয়নের সভাপতি।
অবস্থা এমন হলে আমি দৈনিক বাংলা থেকে পদত্যাগ করব। শেখ সাহেব বললেন, ঠিক আছে পদত্যাগ করুন–And join my Government. আমি বললাম, You have chosen a wrong person. I will not join your Government
শেখ সাহেব চুপ করে থাকলেন। আমি বললাম, আমি আসি। এই বলে রাষ্ট্রপতির কক্ষ থেকে বের হয়ে এলাম। বাইরে এসে দেখলাম সাংবাদিকদের ভিড়। সামনে বাংলাদেশ টাইমস-এর সম্পাদক শহীদুল হক। জিজ্ঞাসা করলেন, কী হলো রে, নির্মল? আমি বললাম, দৈনিক বাংলা থেকে পদত্যাগ করব। চাকরি করব, বেতন নেব, লিখব না, এটা হতে পারে না। শহীদুল হক চিৎকার করে উঠলেন, না নির্মল, তা হয় না। আপনি না থাকলে কেউ থাকবে না। আমাদের কী অবস্থা হবে?
ক্লাবে ফিরে এলাম। বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করলাম। রাজনীতির বন্ধুরা বলল–এ পরিপ্রেক্ষিতে দৈনিক বাংলায় চাকরি করা ঠিক হবে না। তবে ইউনিয়নে থাকতে হবে। কারণ সকল রাজনৈতিক দল ভেঙে দেয়া হয়েছে। কথা বলার কেউ নেই। আপনাকে ইউনিয়ন ছেড়ে গেলে চলবে না।
কিন্তু আমি কী করব? বাকশাল আসছে। মাত্র চারটি দৈনিক থাকবে। তাও ঢাকায়। পরে দুটি দৈনিক বের হতে পারে। আরো থাকবে শতাধিক সাপ্তাহিক। সিনেমা, বিনোদন পত্রিকা। শত শত সাংবাদিক চাকরি হারাবে। আমি এদের কী জবাব দেব? এখন ইউনিয়ন ছাড়লে বলা হবে নির্মল সেন গোপালগঞ্জের লোক, শেখ সাহেবের লোক। আমাদের বিপদে ফেলে চলে গেছে। নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিলাম। পত্রিকা থেকে ছুটি নেব। তারপর দেখব কোথার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? এরপর একটির পর একটি ঘটনা ঘটতে থাকল। একদিন প্রেসিডেন্ট ইউনিয়নকে ডাকলেন পত্রিকা বন্ধ করা নিয়ে। এনায়েতুল্লাহ খান গ্রেফতার হলেন। বন্ধ হলো দ্য পিপল। সম্প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকল। কখনো সে সম্পর্কের আর উন্নতি হয়নি।
নির্দিষ্ট তারিখ মনে নেই। একদিন দুপুরে শুনলাম হঠাৎ সরকার দ্য পিপল পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে প্রথম পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এই পত্রিকাটি পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিল। আমি অবাক হলাম। কারণ সরকারের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছিল ইউনিয়নকে না জিজ্ঞেস করে কোনো পত্রিকা বন্ধ করা হবে না। কারণ বাকশাল আমলে ওই সব ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে আলোচনার মাধ্যমে।
আমি, গিয়াস কামাল, কামাল লোহানী ও রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ নতুন গণভবনে গেলাম। সন্ধ্যা আসছে। গিয়ে শুনলাম কেবিনেট মিটিং শেষ হয়েছে। মন্ত্রিসভার সকল সদস্য লনে পাঁয়তারা করছেন। আমরা ওখানে পৌঁছালে দেখলাম কেউ তেমন অভ্যর্থনা জানায় না। সবাই চুপ। আমি শেখ সাহেবকে বললাম, আমাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমি বললাম, আপনি পিপল বন্ধ করেছেন কেন? আমাদের সকলকে চমকে দিয়ে তিনি বললেন, Nirmal Sen, You are going far. আমি বললাম–প্রেসিডেন্ট, তাহলে You are a Liar. শেখ সাহেব আরো জোরে বললেন, You are going too far. আমি আবার বললাম, Then You are a Liar. একথা বলে আমি বসতে গেলাম। চারদিকে পিনপতন নিস্তব্ধতা। আমি বললাম, আপনার সাথে কথা ছিল আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে কোনো পত্রিকা বন্ধ হবে না। অথচ আজ দুপুরে আমাদের না জানিয়ে পিপল বন্ধ করা হয়েছে। এবার শেখ সাহেবের গলা চড়া হলো। বললেন, মনসুর, পিপল কি বন্ধ হয়েছে? প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলী বললেন, পিপল বন্ধ করা হয়েছে। শেখ সাহেব বললেন, ঠিক আছে, আমি জ্যামাইকা যাচ্ছি। জ্যামাইকা থেকে ফিরে আসার পূর্বে সকলের টাকা পয়সা দিয়ে দেব। আমি বললাম, আমি টাকা চাইতে আসিনি, পত্রিকা চাইতে এসেছি। শেখ সাহেব বললেন, ঠিক আছে, আমি ফিরে আসি।
চারদিকে আবছা অন্ধকার। দূরে বড় কালো গাড়িটার দিকে শেখ সাহেব দাঁড়ানো। দূরে কামাল লোহানীর সঙ্গে দেখা করলেন মনসুর আলী। এ সময় শেখ সাহেব আমাকে কাছে ডাকলেন। বললেন–দেখছেন, পাবনার মানুষ কি ভালো? মনসুর আর লোহানী কথা বলছে। তখন বললাম, হ্যাঁ, হেমায়েতপুরে তাদের বাড়ি।