এরপর আমাদের বৈঠক শেষ হলো। আমি গণভবন থেকে দৈনিক বাংলার জন্যে ফোনে একটি লেখা দিলাম। লেখাটি ছিল বস্তি উচ্ছেদ নিয়ে। জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর ৬৪ ঘণ্টার নোটিশ দিয়ে বস্তি উচ্ছেদ শুরু হয়। এই বস্তি এলাকায় এককালে আমাদের ও পরবর্তীকালে জাসদের সংগঠন ছিল। আমি মনে করি ১৯৬৯ সালের গণঅভুত্থানে বস্তিবাসীরাই সবচে’ বড় ভূমিকা পালন করেছে। তাদের খবর কেউ রাখে না। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এদের উপরই প্রথম হামলা হয়েছে। আবার ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে কেন্দ্রে হাজির করেছে। প্রতিশ্রুতি দেয়া ছাড়া তাদের পুনর্বাসনের কথা কেউ ভেবে দেখেনি। এবারও তারা জরুরি অবস্থার প্রথম শিকার হয়েছে। আমি আমার লেখায় প্রশ্ন করেছিলাম, বছর বছর কি এরাই নির্যাতিত হবে? এদের বলির পাঠার মতো ব্যবহার করা হবে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার কি এদের পুনর্বাসনের কথা ভাবতেও পারত না।
এর কদিন পরে আমার একটি লেখা বের হলো দৈনিক বাংলায়। সে লেখা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। তখন বিশ্ববিদ্যালয় হলে সস্তায় খাবারের ব্যবস্থা ছিল এবং সব খরচই ছিল দুর্নীতিমূলক। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি হলে হাজার হাজার বাড়তি রেশন কার্ড দেয়া হতো। বাড়তি রেশন কার্ড দিয়ে সস্তায় খাওয়ার ব্যবস্থা করা হতো। আমি লিখেছিলাম, এ অস্বাভাবিক ব্যবস্থা চলতে পারে না। শিক্ষাঙ্গনে যদি এভাবে দুর্নীতি চালু করা হয়, সেখানে সুশিক্ষার অবকাশ কোথায়। আমি তো দেখছি সরকারি উদ্যোগে ছাত্রদের চৌর্যবৃত্তি শেখানো হচ্ছে। ছাত্রদের হাতে রাখার জন্যে এটা কোনো কৌশল হতে পারে না। এটা একান্তভাবেই অপকৌশল। অবিলম্বে এটা বন্ধ করা হোক।
তখন বাকশাল আইন জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। সর্বত্র একটি ভয় ও শঙ্কার পরিবেশ। সকল বিরোধী দল, বিরোধী দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছাত্র, যুব শ্রমিক সকল সংগঠন ভেঙে দেয়া হয়েছে। দেশে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল থাকবে। দলের নাম বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)। ছাত্রফ্রন্টের নাম হবে জাতীয় ছাত্রলীগ। এমনি করে জাতীয় শ্রমিক লীগ, জাতীয় কৃষক লীগ নামে বিভিন্ন ফ্রন্ট থাকবে। বাংলাদেশে কাউকে রাজনীতি করতে হলে এই সংগঠনে যোগ দিতে হবে। ভিন্ন কোনো সংগঠন করা যাবে না।
তখন আমাদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। স্কুল জীবন থেকে রাজনীতি করেছি। বাবা-মা, ভাই-বোন কারো দিকে ফিরে তাকাইনি। বছরের পর বছর জেল খেটেছি। একাত্তরে যুদ্ধে অংশ নিয়েছি। সেই স্বাধীন দেশে একটি দল ক্ষমতায় এসে বলল–আর কারো দল থাকবে না। শুধুমাত্র থাকবে তাদের দল। রাজনীতি করতে হলে আমাদের দল অর্থাৎ বাকশালে যোগ দিতে হবে। এই আমাদের দল বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, মোজাফফর ন্যাপ ও একতা পার্টি। তারা সবাই মিলে আমাদের দল ভেঙে দিলেন। আমাদের সাথে একটি কথাও বলা হলো না। জিজ্ঞাসাও করা হলো না এ সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে। অথচ আমরা তার কারো খাস তালুকে বাস করতাম না। আমাদের দল ভেঙে রাজনীতি শেষ করে দেবার জন্যে কাউকে আমরা সংসদে নির্বাচিত করিনি। সরকারি দলের নির্বাচনী ইশতেহারে এমন কোনো প্রতিশ্রুতিও ছিল না। সবচেয়ে বিস্ময়ের এবং দুঃখের হচ্ছে সেকালে যাঁরা এ রাজনীতি করতেন তারা আমাদের মনের অবস্থা ভাবতে চেষ্টা করতেন না। আমাদের দীর্ঘদিনের ত্যাগ তিতিক্ষাকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে চাইলেন। তাঁরা আমার বুকের কাছে যেন ছুরি ধরে বললেন-আমরা তোমাদের রাজনৈতিকভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছি। তোমাদের সমস্ত অতীত সংগ্রামের ইতিহাস নস্যাৎ করে দিচ্ছি। তবে এরপরেও তোমাদের বাকশালকে ভালোবাসতে হবে। এই ভালোবাসা চাওয়া-পাওয়ার বাক বিতণ্ডা এখনো চলছে। আর এ পটভূমিতে আমাকে ডেকে পাঠালেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি এখন প্রধানমন্ত্রী নন। তিনি বাকশালের প্রেসিডেন্ট এবং দেশেরও। আমি সেদিন সংসদ ভবনে গিয়েছিলাম। আমাকে খবর দেয়া হলো প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে ডেকেছেন। আমার সাথে আর কেউ নয়। আমাকে একাই যেতে হবে। সংসদে প্রেসিডেন্টের কক্ষে ঢুকে দেখলাম শেখ সাহেবের সাথে আছেন সংসদ সদস্য মহিউদ্দীন আহমদ। কোটালীপাড়ার সংসদ সদস্য সন্তোষ বিশ্বাস ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারা। আমি ঢুকতেই প্রেসিডেন্ট বললেন, কাল থেকে দৈনিক বাংলায় আপনার লেখা বন্ধ। আপনি উপসম্পাদকীয় লিখতে পারবেন না। আপনি দৈনিক বাংলায় চাকরি করবেন, বেতন নেবেন, এর বেশি কিছু নয়। আমি বললাম, আপনার এ নির্দেশ আমি মানতে বাধ্য নই। আমি আজই দৈনিক বাংলায় আবার লিখব। কারণ এ পত্রিকার মালিক আপনি নন। দৈনিক বাংলা আমাদের রক্তে গড়ে উঠেছে। আপনারা এ পত্রিকার দখলদার মাত্র।
অনেকে বলেন, আমি শেখ সাহেব খুন হওয়ার পর আর সরকারের বিরুদ্ধে লিখিনি। আজো আওয়ামী লীগের বন্ধুরা এ কথা বিশ্বাস করেন এবং মানুষকে বলে বেড়ান। এ কথা সত্যি, ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন করার পর ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাকে লিখতে কেউ বারণ করেনি বা বাধা দেয়নি। মনে রাখতে হবে তখন দেশ স্বাধীন হয়েছে সবেমাত্র। আমাদের কলাম নিষিদ্ধ করা বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হাত দেয়া সম্ভব ছিল না এবং ১৯৭৩ সালের আগস্টে সেকালের সরকার পাকিস্তান আমলের প্রেস আইন নামক কালাকানুন বাতিল করেছিলেন। আর ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে জরুরি আইন জারি করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান আমার লেখা বন্ধ করেন। আমি বারবার এ কথা লিখেছি। কিন্তু এক শ্রেণির রাজনৈতিক নেতা এবং সাংবাদিক আজো বলেন–আওয়ামী লীগের আমলে আমার স্বাধীনতা ছিল। তারপর ছিল না এবং লিখিওনি। একথা সত্যি, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আমার লেখার স্বাধীনতা ছিল। মনে রাখতে হবে আমি বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচিত প্রথম সভাপতি ছিলাম। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। বাকশাল আইন পাস হওয়ার পর তকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে ডেকে নিয়ে জানান–দৈনিক বাংলায় অনিকেত ছদ্মনামে আপনার লেখা আর চলবে না। আপনি চাকরি করবেন–বেতন নিবেন। আপনাকে উপ-সম্পাদকীয় লিখতে হবে না।