প্রধানমন্ত্রী এত উত্তপ্ত ছিলেন, আমি প্রথমে কিছু বলতে পারিনি। এক সময় আমি বললাম, আপনি কার সঙ্গে কথা বলছেন? আমি গোপালগঞ্জের নির্মল সেন নই। বিএফইউজের সভাপতি। প্রধানমন্ত্রী বললেন, বলুন তাহলে আমাকে কী করতে হবে? আমি বললাম–১. এনায়েতুল্লাহ খানের গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করতে হবে। ২. হলিডে বের করতে দিতে হবে। ৩. হলিডে’র আটক কপি ফেরত দিতে হবে। ৪. হলিডে’র নতুন ডিক্লারেশন দিতে হবে। ৫. হলিডে ছাপাবার জন্যে নিউজপ্রিন্ট দিতে হবে। ৬, তথ্য ও বেতার মন্ত্রী শেখ আব্দুল আজিজকে পাল্টাতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী কামাল লোহানীকে জিজ্ঞাসা করলেন, লোহানী, এগুলো করতে হবে নাকি? লোহানী বলল, হ্যাঁ। প্রধানমন্ত্রী বললেন–ঠিক আছে আপনারা যান। কিছুক্ষণ পরে নিচে এসে দেখি শেখ আজিজ এসে হাজির। তিনি আবার ডাক-তার মন্ত্রী হলেন।
যতদূর মনে আছে তখন ছিল রমজান মাস। বিকেলের দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি জিপ পাঠালেন আমার বাসায়। ইফতার পার্টিতে যেতে হবে। ইফতার পার্টিতে গিয়ে দেখলাম এনায়েতুল্লাহসহ সকলে হাজির। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মালেক উকিল খাঁটি নোয়াখালীর ভাষায় কথা বলতে শুরু করলেন। বললেন, আপনি নির্মল সেন-আপনি স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই লিখেছেন। এ লেখা আমি গ্রামে গ্রামে জনসভায় পড়ে শুনিয়ে বলি আমার মানুষকে স্বাভাবিকভাবে মরতেও দিতে পারছি না। এখন কথা হলো, বঙ্গবন্ধু আমাকে একটি সবুজ সংকেত দিয়েছেন। আপনার সকল দাবি মানা হবে।
আমি বললাম, আমার প্রথম প্রশ্ন, সংসদে এনায়েতুল্লাহ খানের বাবার নাম তুলে গালি দিলেন কেন? নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে সংসদে যাদের কথা বলার সুযোগ নেই তাদের সম্পর্কে অবমাননাসূচক কথা বলা যায় না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মালেক উকিল বললেন–ওই সব কথা আর না। দোষ স্বীকার করছি। আপনার সঙ্গে বসতে হবে। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, প্রেস অর্ডিন্যান্স সম্পর্কে আপনাদের আপত্তি আছে। আপনাদের সঙ্গে বসে অর্ডিন্যান্স সংশোধনের ব্যবস্থা করতে বলেছে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর কথা রেখেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। এরপরেও এনায়েতুল্লাহ খানকে জেলে যেতে হয়েছিল। সে প্রেক্ষিত ভিন্ন। আর আমারও কোনোদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বসা হয়নি প্রেস অর্ডিন্যান্স সংশোধনের জন্যে।
এই পটভূমিতে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। বিশেষ ক্ষমতা আইন জারি করা হয়। এ আইনে বিনা বিচারে আটকসহ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের সব ব্যবস্থা করা হয়। আগেই বলেছি আমি তখন বাড়িতে ছিলাম। দেশ স্বাধীন হবার ৩ বছর পরেও বাড়ি যেতে পারিনি। সব সময় একটা আশঙ্কা থাকত কোথায় কী একটা ঘটবে। আমার ঢাকা ছেড়ে যাওয়া ঠিক হবে না। এবার বাড়ি গিয়ে সেই অবস্থারই মুখোমুখি দাঁড়ালাম। জরুরি অবস্থার কথা শুনে ঢাকায় ফিরলাম। ঢাকায় ফিরে শুনি দৈনিক বাংলায় আমার উপসম্পাদকীয় লেখা বন্ধ। সম্পাদকদের মিটিং ডেকে নাকি এই নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। মাথাটা বিগড়ে গেল। পরের দিন সন্ধ্যায় নতুন গণভবনে গেলাম প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে। আমার সাথে ছিলেন গিয়াস কামাল চৌধুরী, কামাল লোহানী ও রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ। আমাকে দেখেই প্রধানমন্ত্রী বললেন, জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরপর আপনি নাকি আত্মগোপন করেছেন। বিবিসি বলেছে, নির্মল সেন ঢাকায় নেই; ঢাকার বাইরে চলে গেছে। আমি বিবিসির খবর শুনিনি। বললাম, আমি বাড়ি গিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী বললেন, শুধু বাড়ি নয়, আপনি বরিশালও গিয়েছিলেন। আমি সবই জানি। আপনি কোথায় কখন যান।
আমি বললাম-–ঠিক আছে, আমি বরিশালও গিয়েছিলাম। আমার প্রশ্ন হচ্ছে আপনি সাপ্তাহিক অভিমত বন্ধ করেছেন কেন? অভিমতের সম্পাদক আলী আশরাফকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন। আমি নই, আলী আশরাফ আত্মগোপন করেছে। প্রধানমন্ত্রী বললেন, আলী আশরাফ কোথায় আছে আমি জানি। তার পত্রিকা বের করার দরকার নেই। আলী আশরাফ বরিশালের বগুড়া রোডে তার বোনের বাসায় সন্তোষ ভবনে আছে। তাকে ইচ্ছে হলেই গ্রেফতার করা যায়। তাকে গ্রেফতার করার ইচ্ছে আমার নেই। তাকে কিছুদিন গোপনে থাকতে বলুন। প্রয়োজন হলে সে ঢাকায় এসে আপনার বাসায় থাকুক। তবে পথে যদি তাকে পুলিশ গ্রেফতার করে আমি কিছু করতে পারব না। কারণ বিশেষ ক্ষমতা আইনে জামিনের ব্যবস্থা নেই। ওকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
আমি বললাম-এবার আমার কথায় আসা যাক। আপনি আমার লেখা বন্ধ করলেন কেন? আর সে কথা আমাকে না জানিয়ে সম্পাদক সাহেবকে জানালেন কেন? তারা তো আপনার সামনেই ভয়ে কথা বলে না। তাদের কাছে এ কথা বলে লাভ আছে? তবে আপনার কথা আমি মানব না। আমি আজকেই এই গণভবন থেকে ফোনে দৈনিক বাংলায় আমার লেখা দেবো। প্রধানমন্ত্রী খানিকটা গম্ভীর হলেন। ইংরেজিতে বললেন নির্মল সেন, আপনাকে আমি জেলে পুরব না; আপনি জনপ্রিয় হবেন। আপনার জন্য একটি সিসার গুলিই যথেষ্ট। আমি বললাম, প্রধানমন্ত্রী, একই কথা আপনার জন্যেও প্রযোজ্য। আপনার জন্যেও একটি সিসার গুলিই যথেষ্ট। প্রধানমন্ত্রী হেসে ফেললেন। বললেন, শুনুন, একটি ঘটনার কথা বলি। সেদিন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে এক সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়েছিলাম। ফিরতে ফিরতে মাধাইয়ার কাছে সন্ধ্যা হয়ে গেল। হঠাৎ মনে হলো কেউ যদি একটা গুলি করে দেয়। তাহলে কী হবে। সবাই চুপ হয়ে গেলাম। আমি বললাম, সব কথাইতো শুনলাম। আমি কিন্তু আজই দৈনিক বাংলায় অনিকেত নামে আবার লিখব। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ঠিক আছে। তবে একটি শর্ত আছে। শর্তটি হচ্ছে আপনি গোপালগঞ্জ ও কোটালীপাড়া নিয়ে লিখতে পারবেন না। আমি বললাম, নিজের এলাকা নিয়ে লিখতে পারব না কেন। সেখানে তো হাজার হাজার মানুষ এখনও পুনর্বাসিত হয়নি। এখনও তাঁবুতে আছে ভারত থেকে ফিরে আসা শরণার্থী। প্রধানমন্ত্রী বললেন, আমি সবই জানি। আপনিও লিখেছেন। কিন্তু নিজের এলাকায় আগে কিছু করা যাবে না। আমি বললাম, গোপালগঞ্জ কোটালীপাড়া সড়ক সম্পর্কে আপনি একই কথা বলেছেন। এ সড়ক শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। আজ পর্যন্ত সে সড়ক সমাপ্ত হলো না। আপনি মাটি কাটার জন্যে একটি বার্জ দিয়েছেন। সেই বার্জ থেকে তেল চুরি হচ্ছে। কোনো কাজের কাজ হচ্ছে না। এ কথা আমি বারবার লিখেছি। আপনি জবাব দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এলাকার কাজ আগে করতে নেই। এতে দুর্নাম হয়।