দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে মতানৈক্য দেখা দেয় বিশেষ করে যুদ্ধে সমাজতন্ত্রীদের ভূমিকা নিয়ে। তখন প্রথম মহাযুদ্ধ এগিয়ে আসছিল। প্রশ্ন উঠেছিল, যুদ্ধে সমাজতন্ত্রী কমিউনিস্টদের ভূমিকা কী হবে। সিদ্ধান্তে বলা হয়েছিল যুদ্ধ হচ্ছে সর্বহারাদের একটি সুযোগ। যুদ্ধের সময় সর্বহারা শ্রেণির রাজনৈতিক দলের কর্তব্য হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে নিজ নিজ দেশের পুঁজিবাদী সরকারকে আঘাত করা এবং এ দুর্বল মুহূর্তে আঘাত করে ক্ষমতা দখল করা।
কিন্তু একমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যতীত কোনো দেশেই এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলো না। গণতান্ত্রিক সমাজবাদী (সোস্যাল ডেমোক্রেটরা) যুদ্ধের সময় জাতীয়তাবাদী হয়ে গেল এবং নিজ দেশের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সহযোগী হল। প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক হলো অর্থহীন-অস্তিত্বহীন।
এই পটভূমিতে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিপ্লবের পর ১৯১৯ সালে তৃতীয়বারের মতো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেন লেনিন। বৈঠক ডাকা হয় মস্কোতে, লেনিনের নেতৃত্বে গঠিত এই আন্তর্জাতিকের নাম হয় তৃতীয় আন্তর্জাতিক বা কমিনটার্ন (কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল)।
তৃতীয় আন্তর্জাতিক গঠনের ৫ বছর পর মারা যান লেনিন। সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে আসেন স্ট্যালিন। স্ট্যালিন নেতৃত্বে আসার পর প্রথম বিতর্ক শুরু হয় সমাজতন্ত্রের সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে। একক বিচ্ছিন্ন একটি দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব কিনা সমাজতন্ত্রের বিজয় বা পূর্ণ বিজয় সম্ভব কিনা এ প্রশ্নে পৃথিবীতে তিনটি মত দেখা দেয়। স্ট্যালিনের মতে, একটি দেশের শুধু সমাজতন্ত্রের বিজয় নয়, পূর্ণ বিজয় সম্ভব। ট্রটীর মতে বিজয় বা পূর্ণ বিজয় আদৌ সম্ভব নয়। এমনকি ইউরোপের অন্যান্য দেশে বিপ্লব না হলে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের বিনির্মাণের কাজ শুরু করা সব নয়। তৃতীয় ধারার মতে, একটি দেশের সমাজতন্ত্রের পূর্ণ বিজয় আদৌ সম্ভব নয়, তবে সমাজতন্ত্রের বিনির্মাণের কাজ শুরু করা যায়। ভারতে প্রথম ধারার অনুসারী ছিল কমিউনিস্ট পার্টি, দ্বিতীয় ধারার অনুসারী ট্রটস্ফীবাদীরা এবং তৃতীয় মতের অনুসারী বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল আরএসপি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্ট্যালিনের নেতৃত্বে তৃতীয় আন্তর্জাতিক স্ট্যালিনের মতকেই গ্রহণ করে এবং প্রচার করতে থাকে।
এই তৃতীয় আন্তর্জাতিকে সঙ্কট দেখা দেয় ১৯২৮ সাল থেকে। তৃতীয় আন্তর্জাতিকে ৬ষ্ঠ কংগ্রেসে নতুন কৌশল নির্ধারণ হয়। গণতান্ত্রিক সমাজবাদীদের (সোস্যাল ডেমোক্র্যাট) ফ্যাসিস্ট বলে আখ্যায়িত করা হয়। এমনকি তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করার নির্দেশ দেয়া হয়। এই তত্ত্ব অনুসারে ভারতের কমিউনিস্টরা ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনের বিরোধিতা করে। কারণ কংগ্রেসের নেতৃত্বে ছিল সংস্কারবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গান্ধী এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। এই তত্ত্বের ভয়াবহ পরিণতি দেখা দেয় পরবর্তীকালে। জার্মানিতে সোস্যাল ডেমোক্র্যাট ও কমিউনিস্টরা বিভক্ত হয়ে যায়। হিটলারের নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থান ঘটে ১৯৩৩ সালে। ১৯৩৫ সালে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসের বৈঠক বসে। এবার পপুলার ফ্রন্টের তত্ত্ব আনা হয়। বলা হয়, ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থানের ফলে পৃথিবীতে নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবী এখন তিন ভাগে বিভক্ত– (১) সোভিয়েট সমাজবাদ (২) গণতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ (ব্রিটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) (৩) ফ্যাসিবাদ। বলা হয় ফ্যাসিবাদকে রুখবার জন্য গণতান্ত্রিক সমাজবাদীদের সাথে ঐক্য করা যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লেনিনপন্থী দাবিদার কমিউনিস্ট সোসালিস্টদের পক্ষ থেকে বলা হলো–এটা সোভিয়েত ইউনিয়নকে বাঁচাবার কৌশল। এতে লেনিনবাদের চিহ্নমাত্র নেই।
এ ব্যাখ্যা সত্য প্রমাণিত হলো ১৯৩৯ সালে। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ঘনঘটা। যে কোনো মুহূর্তে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। ঐ মুহূর্তে আগস্ট মাসে জার্মানি রাশিয়ার সাথে অনাক্রমণ চুক্তি করল। অর্থাৎ জার্মানি তখন পশ্চিম ইউরোপ আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পূর্বে রাশিয়াকে ঠেকা দেয়াই ছিল এ চুক্তির লক্ষ্য। অথচ পপুলার ফ্রন্ট তত্ত্বে ফ্যাসিবাদের সাথে চুক্তির কথা ছিল না। বিশ্বের রুশপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিগুলো এ সত্ত্বেও বলল, এটাই সঠিক। এবার যুদ্ধ হচ্ছে জার্মানি ও ব্রিটেন-ফ্রান্সের সাথে। এ যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ। এ যুদ্ধে আমাদের নিজ দেশের সরকারকে উৎখাতের সংগ্রাম করতে হবে। ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টি বলল–এ যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ। এ যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। কিন্তু তেমনটি ঘটল না। ১৯৪১ সালের জুন মাসে জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করল। বিশ্বের মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের এবার স্লোগান পাল্টে গেল। এবার আর সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ নয়। রাশিয়া আক্রান্ত হওয়ায় এ যুদ্ধ জনযুদ্ধে পরিণত হয়েছে। সুতরাং পপুলার ফ্রন্ট তত্ত্ব অনুযায়ী গণতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ, ফরাসি, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের যুদ্ধকালীন বন্ধু। এদের বিরুদ্ধে এখন কোনো আন্দোলন নয়। এখন যুদ্ধ ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করার জন্য। এ তত্ত্বের ফলে ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টি যুদ্ধের সময় ব্রিটিশের সাথে সহযোগিতা করে। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করে। সুভাষচন্দ্র বসুকে ফ্যাসিস্টদের দালাল বলে আখ্যা দেয়।