কিন্তু ভারতের কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের একটি দীর্ঘ দিনের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের ঐতিহ্য ছিল। আবার ভারতীয় শিল্পপতিদের তেমন মূলধনের সঙ্কট ছিল না। তাই ভারতের কংগ্রেস নেতারা পুঁজিবাদী বা সমাজতান্ত্রিক কোনো শিবিরেই পুরোপুরি যোগ দেননি। তাঁরা দরকষাকষি করে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছেন এবং এ ভিত্তিতে ভারতের পররাষ্ট্র নীতি ছিল গোষ্ঠী নিরপেক্ষ। আর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতি ছিল পাশ্চাত্য ঘেঁষা।
তবে পশ্চিমা ঘেঁষা পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করতেও পাকিস্তানকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছিল–পাকিস্তান কোন পক্ষে যাবে? পাকিস্তান এককালে ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটেন পাকিস্তানকে কজায় রাখতে চেয়েছে। অপরদিকে পাশ্চাত্যের রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিশ্ব রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে ব্রিটেনকে হটিয়ে নেতৃত্বে এসে যায়। সে পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে ব্রিটেনের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী। এ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। ফলে পাকিস্তানের ব্রিটেন লবিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। তখন পাকিস্তানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন খাজা শাহাবুদ্দীন। তকালীন পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের কনিষ্ঠ ভাই, খাজা পরিবার বরাবরই ব্রিটিশ রাজনীতির পরম সুহৃদ।
শাহাবুদ্দীনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রিত্বের আমলে ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডিতে এক জনসভায় ভাষণ দেয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান প্রকাশ্য দিবালোকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। লিয়াকত আলীর হত্যাকারী সৈয়দ আকবর একজন জেলমুক্ত আসামী। সে সীমান্তের হাজেরা জেলায় অন্তরীণ ছিল। সে লিয়াকত আলীকে গুলি করার সাথে সাথে অপর একজন পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা তাকে গুলি করে হত্যা করে। অর্থাৎ লিয়াকত আলীর সঙ্গে তার হত্যাকারীকেও পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। ফলে লিয়াকত হত্যার ঘটনা আর কোনোদিনই জানবার সুযোগ থাকল না। রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে, এটা ছিল পাকিস্তানের রাজনীতিতে ব্রিটিশ ও মার্কিন লবির সঙ্কটের অনিবার্য পরিণতি। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান মিত্রের সন্ধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীনের উপদল এটা পছন্দ করেনি। তাই নিহত হলেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। হত্যাকারী একজন অন্তরীণ ব্যক্তি। প্রশ্ন দেখা দিল এই অন্তরীণ মানুষটি হাজেরা থেকে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে কী করে রাওয়ালপিন্ডিতে এল। কেনই বা হত্যাকারীকে মামলার স্বার্থে বাঁচিয়ে না রেখে সাথে সাথেই হত্যা করা হলো। এ রহস্যের জট আজো পাকিস্তানের রাজনীতির অঙ্গনে কেউ খুলবার চেষ্টা করেনি। লিয়াকত আলী নিহত হলেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে ব্রিটিশ লবি আর মার্কিন লবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে পারলেন না।
জেলখানায় কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছিল কমিনফর্মের নির্দেশে। কমিনফর্ম হচ্ছে কমিউনিস্ট ইনফরমেশন ব্যুরো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে কমিনফর্ম গঠিত হয়েছিল ৯টি দেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে নিয়ে। এ ৯টি দেশ হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, হাঙ্গেরি, যুগোশ্লাভিয়া, চেকোশ্লাভিয়া, ইতালি ও ফ্রান্স। কমিনফর্মের লক্ষ ছিল বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা, সংবাদ আদান-প্রদান। কিন্তু কমিনফর্মও এক সময় তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক কমিনটার্ন-এর ভূমিকা গ্রহণ করে। অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশ বাস্তবায়নই এককালে কমিনফর্মের কাজ হয়ে দাঁড়ায়। এ পরিস্থিতির প্রতিবাদ করলে ১৯৪৮ সালে জুন মাসে যুগোশ্লাভিয়াকে কমিনফর্ম থেকে বহিষ্কার করা হয়। কমিনফর্মের প্রধান দফতর বেলগ্রেড থেকে রুমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্ট স্থানান্তরিত করা হয়। আবার ক্রুশ্চেভের আমলে যুগোশ্লাভিয়াকে খুশি করতেই ১৯৫৭ সালের ১৭ এপ্রিল কমিনফর্ম ভেঙে দেয়া হয়। এই ক্ষেত্রে কমিনফর্মই হচ্ছে শেষ কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সংস্থা।
রাজনীতির ইতিহাসে আন্তর্জাতিকভাবে শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যবদ্ধ করার প্রথম প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন কার্ল মার্কস। ১৮৪৮ সালে কার্ল মার্কস ও ফ্রিডারিক এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করেন। এ ম্যানিফেস্টোতে বলা হয় যে-পৃথিবীর ইতিহাস হচ্ছে শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস এবং একদিন পুঁজি ও শ্রমের তীব্র সংঘর্ষের ফলে শ্রমিক শ্রেণি ক্ষমতায় আসবে এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হবে শোষণহীন সমাজ।
এই কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর পরিপ্রেক্ষিতেই মার্কস-এঙ্গেলস আন্তর্জাতিকভাবে শ্রমিক শ্রেণিকে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। ১৮৬৪ সালে তিনি গড়ে তোলেন ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং মেনস অ্যাসোসিয়েশন। ১৮৭৬ সাল পর্যন্ত এ সংগঠন বেঁচে ছিল। মার্ক ১৮৮৩ সালে মারা যান। মাকর্মপন্থীরা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন ১৮৮৯ সালে। প্যারিসে ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কারস কংগ্রেসের বৈঠক বসে। নামকাওয়াস্তে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক বেঁচে ছিল ১৯১৪ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে মতানৈক্য ছিল চরম।