তবুও এ চিঠি নিয়ে হৈচৈ ছিল জেলখানায়। একটি চিঠি এলে সে চিঠি বারবার পড়া হতো। প্রতিটি বাক্য বিশ্লেষণ করা হতো। আবিষ্কার করার চেষ্টা হতো ঐ চিঠিতে কোনো গোপন সংকেত আছে কিনা। জেল থেকে মুক্তি পাবার ইঙ্গিত আছে কিনা। তাই যাদের চিঠি আসত না তাদের মন খারাপ হয়ে যেত। আমার সব সময় মনে হয়েছে জেলে যাদের আত্মীয়-স্বজন আছে তাদের উচিৎ ঐ বন্দিকে চিঠি লেখা। সে বন্দি রাজবন্দি হতে পারে, খুনের আসামী হতে পারে। হতে পারে ভিন্ন কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত। আমার অনুরোধ জেলখানার স্বজনদের জন্য চিঠি লিখবেন। সে যেই হোক না কেন। চিঠির অভাব আমার কোনোদিনই হয়নি। আমার চিঠি ছিল সকলের কাছে ঈর্ষার।
এ চিঠি আসা না আসা নিয়ে জেল জীবনে একটি বিরাট অংশ কাটে। আবার জেলে কোনো অপরাধ করলে চিঠি লেখা এবং চিঠি পাওয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তেমনটি হতে অনশনের সময়। যারা অনশন করত তারা জেলখানার আইনে অপরাধী। তাই তাদের চিঠি বন্ধ করে দেয়া হতো। বন্ধ করা হতো বাইরের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সাক্ষাতকার।
১৯৫০ সালে জেলখানার চতুর্থ অনশন শেষ হবার পর এই অনশন পর্ব শেষ হলো। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নতুন সিদ্ধান্ত নিল জেলখানার আন্দোলন সম্পর্কে। কমিনফর্ম কমিউনিস্টদের কনফর্মেশন ব্যুরো ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির তীব্র সমালোচনা করে জানাল, তাদের রাজনীতি নিতান্তই ভুল। তাদের সমালোচনায় বলা হলো জেলখানা হচ্ছে শ্রেণি শত্রুর সবলতম ঘাঁটি। সেই ঘাঁটির মধ্যে তারা হচ্ছে সর্বশক্তিমান। সেখানে বিপ্লব করার চেষ্টা অথবা শত্রুর সাথে একটা সরাসরি বোঝাঁপড়ার কর্মসূচি ছিল নিতান্তই ভুল। শত্রুর এই সবলতম ঘাঁটিতে শত্রুকে আঘাত করতে গিয়ে সংগঠনের দিক থেকে পার্টি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কমিনফর্মে এই সমালোচনায় জেলখানায় আমাদের অনশনের বহর কমল। কিন্তু ইতিমধ্যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে রাজবন্দিদের ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে। রাজশাহীর সাঁওতাল এলাকায় গ্রেফতার করে ইলা মিত্রের ওপর চালানো হয়েছে ইতিহাসের জঘন্যতম অত্যাচার। রাজশাহী জেলে পাখির মতো গুলি করে মারা হয়েছে রাজবন্দিদের। সে পর্ব শেষ হলো কমিনফর্মের নির্দেশে। এ কমিনফর্ম কী? এর নির্দেশ ভারতীয় কমিউনিস্ট পাটির শুনতে হবে কেন?
১৯৫০ সালে জেলখানায় মোটামুটি তেমন কোনো গোলমাল ছিল না। কমিউনিস্ট পার্টির সেকালের কৌশল পরিবর্তন হয়েছে। জেলখানায় আন্দোলন স্তিমিত। তবে জেলখানা থেকে কবে মুক্তি পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে কেউই তেমন নিশ্চিত নয়। ১৯৫০ সালে দাঙ্গার পরে কেউই জানে না কার ভবিষ্যৎ কী হবে?
পাকিস্তানের রাজনীতিতেও এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে তখন। ১৯৪৮ সালে ১১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মারা যান। একক নেতৃত্বে আসেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। লিয়াকত আলী ভারতের উত্তর প্রদেশের অধিবাসী। ভারত ভাগ হওয়ার সময় তিনি পাকিস্তানে আসেন। মুসলিম লীগের সম্পাদক হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। মুসলিম লীগের নেতা হিসেবে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খান-ই বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। জিন্নার মৃত্যুতে নেতৃত্ব শূন্যতা দেখা দেয়। পাকিস্তানে গভর্নর জেনারেল কে হবে সেই বিতর্ক উঠতে থাকে। কে মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট হবেন সে প্রশ্নও দেখা দেয়। এ সময় পাকিস্তানের আমলারা ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করেন। গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত একাউন্ট সার্ভিসের গোলাম মোহাম্মদ। তিনি ভারতের হায়দারাবাদের নিজাম সরকারের অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন। পাকিস্তানের মন্ত্রিসভার প্রথম অর্থমন্ত্রী ছিলেন। গোলাম মোহাম্মদের গভর্নর জেনারেল পদে নিযুক্তির পর পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন খেলা শুরু হয়। মুসলিম লীগের সভাপতি হন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান নিজেই।
তখন মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ছিলেন জমিদার, জোতদার এবং নব্য শিল্পপতিরা। এই জমিদার ও জোতদারের স্বাভাবিক মিত্র ছিল সামরিক ও বেসামরিক আমলারা। জিন্নাহ এবং লিয়াকত আলীর মতো ব্যক্তিত্বের উপস্থিতির জন্য তাঁদের জীবিতকালেই আমলারা রাজনীতিতে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। কিন্তু জিন্নার মৃত্যুর পর ক্ষমতায় প্রভাব বিস্তার করার জন্য সামরিক ও বেসামরিক আমলারা তৎপর হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর তখন পৃথিবীতেও ছিল ভিন্ন পরিস্থিতি। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিম শিবির, অপরদিকে সোভিয়েন ইউনিয়ন। পশ্চিম মহলে তখন ভয়, যে কোনো দেশে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসতে পারে। এছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশের কাছে চীন। চীনেরও বিপ্লব হয় ১৯৪৯ সালে। সারা পৃথিবীতে তখন চরম কমিউনিস্ট আতঙ্ক। কমিউনিস্টদের ঠেকাবার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৎপর। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিস্ট বিরোধী উদ্যোগ দ্বিধা-বিভক্ত হলো ভারতীয় উপমহাদেশে।
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান এই সময়ে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু তখন দুটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এক ছিল না। ব্রিটিশ আমলের প্রায় সকল শিল্প কারখানাই ভারতীয় এলাকায় পড়েছিল। ব্রিটিশ আমলেই এক শ্রেণির শিল্পপতি ভারতে জন্ম নিয়েছিল। এই শিল্পপতিরা অনেক ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পপতিদের সাথে টক্কর দিতে পারত। তাই ভারত স্বাধীন হবার পর থেকে বিভিন্ন প্রশ্নে ব্রিটিশ-মার্কিনসহ পাশ্চাত্যের সরকারের সাথে ভারতের মতানৈক্য শুরু হয়। কমিউনিস্ট বিরোধিতার নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন একের পর এক চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেয়। পাকিস্তান এ উদ্যোগের সামিল হলেও ভারত সরকার কোনোদিনই এ ধরনের উদ্যোগের সাথে যুক্ত হয়নি। পাকিস্তানের কাছে পরিস্থিতি ভিন্নতর। পাকিস্তানে শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধন ছিল না। তাকে মূলধন সংগ্রহ করতে হতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেনের কাছ থেকে। আর এই মূলধন পাওয়া কখনোই শর্তহীন ছিল না। তাদের শর্ত ছিল, কমিউনিস্টদের প্রতিরোধ করতে হবে, প্রতিরক্ষা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হবে, অন্যথায় সাহায্য মিলবে না। অপরদিকে পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ অর্থাৎ এককালের মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের সাংগঠনিকভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের কোনো ঐতিহ্য ছিল না। ফলে পাকিস্তান জন্মলগ্ন থেকেই পাশ্চাত্যের শিবিরে চলে যায়।