এ পরিস্থিতিতে আমি সরকারি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া হলো। অনেকে সাধুবাদ জানালেন। অনেকে স্পষ্টতই বললেন, সরকারের এ প্রস্তাব গ্রহণ করা উচিত ছিল। কারণ কোন কালে মুক্তি পাওয়া যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। পাকিস্তানে কবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন হবে এবং তারপরে আমরা মুক্তি পাব সে কথা সঠিক করে বলা আদৌ সম্ভব নয়। তাই তাদের মতে, এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা আদৌ সঠিক ছিল না।
এর পরপরই এক মর্মান্তিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দুই বাংলার বড় খবর হয়ে উঠল। জেলখানায় কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। একমাত্র পত্রিকা দৈনিক আজাদ আর কলকাতার স্টেটসম্যান। কোনো কাগজ থেকেই প্রথম দিকে দাঙ্গার ভয়াবহতা অনুধাবন করা যায়নি। মাস তিনেক পরে এক খ্রিস্টান যাজক বরিশালের দাঙ্গা সম্পর্কে স্টেসসম্যানে ধারাবাহিক লিখতে শুরু করেন। এই ধর্ম যাজকের নাম এডওয়ার্ড ম্যাক-ই নার্নি। ১৯৪৬ সালে দাঙ্গার সময় তিনি নোয়াখালীর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। সেই সুবাদে আমার সাথে মৈত্রী ও বৈরী সম্পর্ক হয়েছিল তার সাথে বরিশালে। সে কাহিনীতে পরে আসব।
ম্যাক-ই নার্নির রিপোর্ট থেকে বোঝা গেল যে, পূর্ববাংলার অবস্থা আদৌ স্বাভাবিক নয়। বরিশালের বন্দিরা উদগ্রীব হলেন। দীর্ঘদিন যাবত পরিবার পরিজনের কোনো খবর নেই। চারদিকে অনিশ্চয়তা, আশঙ্কা এবং চরম অসহায়ত্ব।
এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে চুক্তি হলো। এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। এ চুক্তি নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি নামে পরিচিত। এ চুক্তিতে বলা হলো–পূর্ববাংলার যে হিন্দুরা পশ্চিম বাংলায় যেতে চান বা পশ্চিম বাংলার যেসব মুসলমান পূর্ব বাংলায় যেতে চান দুই সরকার যৌথভাবে তাঁদের স্থানান্তরের দায়িত্ব নেবে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কলকাতা, বরিশাল, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জের মধ্যে স্টিমার চলাচল শুরু হলো। লাখ লাখ মানুষ দেশান্তরী হলো।
আমার তখন বারবার জেলখানায় মাওলানা আবুল কালাম আজাদের কথা মনে হলো। দেশ বিভাগের সময় তিনি এ প্রশ্নটি তুলেছিলেন। প্রশ্ন তুলেছিলেন উভয় দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার প্রশ্নে। সে প্রশ্নের জবাব মিলল ১৯৫০ সালে। প্রমাণিত হলো সাম্প্রদায়িক বিভক্তির ভিত্তিতে স্বাধীনতা সাম্প্রদায়িক সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেয় না। দিতে পারে না।
সে এক অদ্ভুত স্বাধীনতা। ভারতের মুসলমান জানে না সে তার জন্মভূমিতে থাকতে পারবে কিনা। পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা জানে না তারা আদৌ নিরাপদ কিনা। দুটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রনায়কেরা চুক্তি করে নিজের দেশের নাগরিকদের ভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দিল। পৃথিবীতে এর কোনো নজির নেই। তাহলে এ স্বাধীনতা কার? কাদের জন্য এ স্বাধীনতা? হিন্দু মুসলিম যদি দুই জাতিই হয়ে থাকে, যদি এক সাথে তাদের না থাকা হয়, সে জন্য যদি দেশ ত্যাগ করতে হয়, তাহলে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে লোক বিনিময় কেন করা হলো না? কেন জানমালের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা না করে এই উপমহাদেশকে ভাগ করা হলো সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে?
জেলখানায় আমার এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া সম্ভব ছিল না। কাউকেই স্বাভাবিক মনে হতো না। সকলেই মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কারো কোনো ধারণা নেই। ১৯৫০ সালে দাঙ্গার পর পরিস্থিতি এমন হলো, কেউই জানে না এ মুহূর্তে তাকে মুক্তি দেয়া হলে সে কোথায় যাবে, কোথায় গিয়ে উঠবে। কে তাকে আশ্রয় দেবে। আদৌ পূর্ববাংলা নামক জন্মভূমিতে তার জন্য কোনো আশ্রয় আছে কিনা।
একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল ভারত থেকে আসা কমরেডদের নিয়ে। তখন কমিউনিস্ট পার্টি ও আরএসপি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পাকিস্তানে মুসলিম কমরেড ও ভারতে হিন্দু কমরেডরা রাজনীতিতে মুখ্য দায়িত্ব পালন করবে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কমিউনিস্ট পার্টির অসংখ্য মুসলিম কমরেড পশ্চিমবাংলা থেকে পূর্ববাংলা চলে আসেন। তারা পূর্ববাংলার বিভিন্ন কারাগারে আমাদের সাথে দিনের পর দিন অনশন ধর্মঘট করেন। অনেকের স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। ১৯৫০ সালের দাঙ্গা ও নেহেরু-লিয়াকত চুক্তির পর তাঁদেরও নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়।
জেলমন্ত্রী চলে যাবার পরেও পরীক্ষা নিয়ে তেমন কোনো সুরাহা হয়নি। দিনের পর দিন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে জানাতে থাকলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় বলে আমাকে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে পরীক্ষা দেবার অনুমতি দেয়া যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘদিন আবেদন নিবেদনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত আমার কাজে এল না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানালেন, এ সিদ্ধান্ত বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য প্রযোজ্য নয়। নিশ্চিত হয়ে গেল যে, জেলে থাকতে আমার আর পড়াশোনা করা সম্ভব নয়।
একদিক থেকে জেলখানায় আমি ছিলাম ভাগ্যবান। ভাগ্য বলে কিছু বিশ্বাস করি কিনা সে প্রশ্ন বিতর্কিত। তবে জেলখানায় যাদের চিঠি আসত তাদের ভাগ্যবান মনে হতো। সে এক অদ্ভুত মানসিকতা। অবরুদ্ধ দেয়ালের জগতে চিঠি হচ্ছে বাইরের খবর। বাইরের সাথে যোগাযোগ। তাই সকলেই প্রতিদিন চিঠির জন্য অপেক্ষা করত। জেল অফিস থেকে কেউ এলে জিজ্ঞাসা করা হতো চিঠি এসেছে কিনা। আর জেলের ঠিকানায় চিঠি এলেই যে আমাদের হাতে পৌঁছাবে তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। জেল অফিসে চিঠি পৌঁছালে সেন্সরের জন্য গোয়েন্দা অফিসে পাঠানো হতো। অনেক চিঠি গোয়েন্দা অফিস বাজেয়াপ্ত করত। আবার কোনো চিঠির কোনো অংশ কেটে দিত। ফলে জেল অফিসে কোনো চিঠি পৌঁছাবার পর সে চিঠি রাজবন্দিদের হাতে পৌঁছাতে দীর্ঘদিন লেগে যেত। আবার অনেক চিঠিই দেয়া হতো না।