সে পরিস্থিতিতে খান সাহেবের পক্ষে আমার সাথে দেখা করা ছিল দুঃসাধ্য কাজ। এ কাজটি তিনি করেছিলেন। গোয়েন্দা বিভাগের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন ঢাকায়। সাথে ছোট কাকা। তাদের একমাত্র অনুরোধ সরকারের কাছে মুচলেকা দিতে হবে আমি রাজনীতি করব না। এই মুচলেকা দেবার সাথে সাথে আমি মুক্তি পেয়ে যাব। আমি রাজি হলাম না। খান সাহেব ক্ষুব্ধ হলেন। কাকা বিদায় নিলেন চোখের জলে।
সেই ঘটনারই যেন আরেক ধরনের পুনরাবৃত্তি হচ্ছিল ১৯৫০ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটে। অ্যাডভোকেট রমেশ তালুকদারের কথা শুনে আমার মাথা যেন বিগড়ে গেল। আমি বললাম, আমি কোনো শর্তে মুক্তি চাই না। আমার লেখাপড়ার কথা আপনাদের ভাবতে হবে না। আমি কোথায় যাব, কোন দেশে থাকব সে সিদ্ধান্ত আমিই নেব। আর আপনারা আমার কেউ অভিভাবক নন। এ ব্যাপারে আমাকে উপদেশ দেবার চেষ্টা করবেন না। আমার কথা শুনে রমেশ বাবুর মুখ কালো হয়ে গেল। মনে হয় তিনি সরকার পক্ষকে বুঝিয়েছিলেন যে তিনি আমাকে রাজি করাতে পারবেন। আমার কথায় সব কিছু ভেস্তে গেল।
এরপর আর কথা জমল না। পুলিশ অফিসার একটি নতুন নির্দেশ বের করলেন। ঐ নির্দেশে আমার আটকাদেশ আরো ৬ মাস বাড়িয়ে দেয়া হলো। আমি জেলখানায় আমার ওয়ার্ডে ফিরে এলাম। জেলখানার বন্ধুরা অনেক খুশি হলেন। অনেকে ভিন্ন কথা বললেন। তখন একটা ভিন্ন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল ঢাকা জেলে। দীর্ঘদিন অনশনে আমার স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে। কোনোকিছুই হজম হচ্ছে না। মাসের পর মাস দু’বেলা বার্লি খেয়ে কাটাতে হচ্ছে। ভিন্ন পরিবেশে ঘটে যায় ৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। আমি আর একটি আটকাদেশ নিয়ে ঢাকা জেলে ফিরে এলাম। পাকিস্তান সরকারের প্রস্তাব ছিল–আমাকে মুক্তি দেয়া হবে। শর্ত হচ্ছে–আমাকে পাকিস্তান ছাড়তে হবে। কিন্তু সে প্রস্তাবে আমি রাজি হলাম না। ফলে আটকাদেশ আরো ৬ মাস বৃদ্ধি পেল। তখন প্রায় ২ বছর জেল খাটা হয়ে গেছে।
জেলে তখন ভিন্ন পরিস্থিতি। কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনশন করে সকলেরই শরীর ভেঙে গেছে। চতুর্থ অনশন ধর্মঘটের সময় কুষ্টিয়ার শিবেন রায় মারা গেছেন। সে এক মর্মান্তিক কাহিনী। ঢাকা জেলে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে শিবেন রায়কে রাখা হয়েছিল তৃতীয় শ্রেণির কয়েদীর মতো। শুয়ে থাকতে হতো মেঝেতে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ৬ নম্বর সেলে কখনো সূর্যের আলো পাওয়া যায় না। ব্রিটিশ আমলের নির্জন সেল। কুষ্টিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শিবেন রায়। ঐ সেলেই তিনি অনশন শুরু করেন। ডাক্তাররা অনশনের ৪ দিন পর অন্য বন্দির মতো তাকেও জোর করে নাক দিয়ে দুধ খাওয়াবার চেষ্টা করেন।
নাক দিয়ে দুধ খাওয়ানোর একটা বিপদ আছে। দুধ খাওয়ার নলটি নাক দিয়ে ঢুকে পাকস্থলিতে না গিয়ে সাংসে চলে যেতে পারে। সাংসে চলে গেলে মৃত্যু অনিবার্য।
শিবেন রায়ের ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল। সেই দুধ খাওয়ানোর পদ্ধতি ছিল বীভৎস। জেলের সিপাইরা জোর করে রাজবন্দিদের মেঝেতে ফেলে দিত। হাত পায়ের ওপর বসত। কখনো বুকের ওপরও বসত। তারপর ডাক্তার নাকে নল ঢুকিয়ে নাড়াচাড়া করত। ফলে দুধের নল সরে যাবার সম্ভাবনা থাকত। শিবেন রায়কে দুধ খাওয়ার সময় নলটি লাংসে চলে যায়। নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়। অন্যান্য সেলে খবর গেলে প্রতিবাদে রাজবন্দিরা শ্লোগান দিতে থাকে। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ কোনো ক্ৰক্ষেপ করল না। আবার জোর করে একইভাবে তাকে দুধ খাওয়ানো হলো। ফলে মৃত্যু হলো শিবেন রায়ের। এবারের অনশনে রাজবন্দিরা কিছুটা জয়ের মুখ দেখল। রাজবন্দিদের অন্যান্য বন্দিদের চেয়ে পৃথক মর্যাদা দেয়া হলো। রাজবন্দিদের দু’শ্রেণিতে বিভক্ত করা হলো। শিবেন রায়ের মৃত্যু ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন জেলখানার আন্দোলনে প্রভাব বিস্তার করল।
সঙ্কট দেখা দিল ভিন্ন প্রশ্নে। আমি আগেই উল্লেখ করেছি, পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাইকারি হারে বামপন্থীদের ধরপাকড় শুরু হয়। এদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারের। সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দেশ ভাগ হওয়ায় প্রতিটি পরিবারে শঙ্কা। কোনো পরিবারই স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি আদৌ তারা পাকিস্তানে থাকবে কিনা। বাড়তি অসুবিধা দেখা দিয়েছে ঘরে ঘরে রাজনৈতিক কর্মী থাকায়। তাদের ধারণা হয়েছে রাজনৈতিক কারণেই হয়তো তাদের দেশান্তরী হতে হবে।
পারিবারিক এই সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যেই গ্রেফতার হয়ে জেলখানায় এসেছে অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা। তারা জেলে আসার পর তাদের ঘরবাড়ি তছনছ হয়েছে। নির্যাতিত হয়েছে আত্মীয়-স্বজন। জেলে থাকাকালে অনেকের পরিবার দেশ ত্যাগ করে চলে গেছে। অর্থাৎ এদের পারিবারিক ও রাজনৈতিক জীবন একান্তভাবেই অনিশ্চিত।
জেলখানায়ও এই অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই স্থির করতে পারেনি মুক্তি পেলে তারা কোথায় যাবে। আদৌ পাকিস্তানে থাকবে কিনা। অনেকে আবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মুক্তি পেলেই দেশ ছেড়ে চলে যাবে। এ ব্যাপারে লেখালেখিও করেছে পূর্ববাংলার সরকারের সাথে। এদের মধ্যে অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টির বিশিষ্ট নেতা ও কর্মী।
আর এর মাঝখানেই কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সংগ্রামের ডাক এসেছে। জেলখানায় একের পর এক অনশন ধর্মঘট হচ্ছে। সংঘর্ষ হচ্ছে। আর বিপাকে পড়েছে এই রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা। তাদের সাথীরা জেলখানায় অনশন করছে। সংঘর্ষ করে জীবন দিচ্ছে। অথচ তারা এই সংগ্রামের শরিক হতে পারছে না। সে ছিল এক মর্মান্তিক জ্বালা।