এর মাঝখানে হঠাৎ একদিন জেল অফিসে আমার ডাক পড়ল। দেখলাম এক আইবি অফিসার বসে আছেন। তিনি বললেন, আপনার নাম কি নির্মল সেন? আপনি রাশিয়ার লোক। আপনি কোনোদিন জেল থেকে মুক্তি পাবেন না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন? তখন তিনি হাইকোর্টের শুনানির এক অপূর্ব বিবরণ দিলেন। হাইকোর্টে তখন আমার মামলার বিচারপতি ছিলেন জাস্টিস এলিস, জাস্টিস ইস্পাহানি ও জাস্টিস ইব্রাহিম। আমার পক্ষের উকিল অ্যাডভোকেট রায়বাহাদুর রমেশ তালুকদার নাকি বলেছিলেন, মাননীয় বিচারপতি, আমার মক্কেল নির্মল সেনের বয়স খুব কম। সে গান্ধী পরবর্তী যুগের রাজনৈতিক কর্মী এবং সহিংসতায় বিশ্বাস করে না। বিচারপতি এলিস অ্যাডভোকেট তালুকদারকে জিজ্ঞেস করলেন আপনি লেনিনের নাম শুনেছেন? লেনিন সোভিয়েত ইউনিয়নে সহিংস বিপ্লব করেছিল। আপনার মক্কেল নির্মল সেন বরিশালে লেনিন দিবস পালন করেছেন। সুতরাং নির্মল সেন অহিংসায় বিশ্বাস করে, এ তথ্য সঠিক নয়।
গোয়েন্দা বাহিনীর ভভদ্রলোক হাইকোর্টের শুনানির এই অংশটুকু শুনেই জেলখানায় চলে এসেছিলেন এবং তার ধারণা বলেছিলেন আমাকে। তিনি নিঃসংশয় যে আমি রাশিয়ার লোক এবং কোনোদিনই আমার মুক্তি হবে না। তবে এ কথা সত্য যে ঢাকা হাইকোর্ট আমার রিট পিটিশন অগ্রাহ্য করেছিল। একই রায়ে আমার সাথে আরো ২১ জনের রিট পিটিশন অগ্রাহ্য হয়ে গেল।
তবে এ চিত্রের অপর পিঠও আছে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন কারাগারে আটক রাজবন্দিদের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করা হয়। আমাদের পক্ষে উকিল ছিলেন হামিদুর রহমান ও বীরেন চৌধুরী। হামিদুর রহমান পরবর্তীকালে হাইকোর্টের বিচারপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হয়েছিলেন এবং পাকিস্তানের রাজনীতিতে পরিচিত হয়েছিলেন বিভিন্ন কারণে। তখন অ্যাডভোকেট জেনারেল ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। এবার হাইকোর্টের রায়ে আমাদের মুক্তির আদেশ দেয়া হলো। অ্যাডভোকেট জেনারেল তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীনকে আমাদের মুক্তি দেবার অনুরোধ জানালেন। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার অনড়। তারা নতুন অর্ডিন্যান্স জারি করল। ঢাকা জেলের চারপাশে ঘিরে ফেলা হলো পুলিশ ও পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলের লোক দিয়ে। আমাদের জেল গেটে নিয়ে যাওয়া হলো। এক এক করে মুক্ত করে জেলের বাইরে দাঁড় করানো হল। আর সাথে সাথে ভিন্ন পুলিশ অফিসার আমাদের নতুন নির্দেশ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আপনাদের এই আইনে গ্রেফতার করা হলো এবং আপনাদের ঢাকা জেলেই আটক রাখা হবে।
সে এক অপূর্ব নাটক। হাইকোর্টের নির্দেশে আমাদের ছেড়ে দেয়া হতে পারে এমন একটা খবর পাওয়া গিয়েছিল আগেই। অনেকে উৎফুল্ল হয়েছিল। ভেবেছিল লৌহ কপাটের বাইরে হয়তো নিজের বাড়ি যাওয়া যাবে। অনেকে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু তেমনটি ঘটল না। সকলকে নতুন আটকাদেশ দিয়ে আবার জেলখানায় ঢুকতে হলো। তখনকার মনের অবস্থা যারা কোনোদিন জেলে যায়নি, তাদের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। কিছুদিন পরে আরেকটি ঘটনা ঘটল আমাকে নিয়ে। বিকালের দিকে জেল গেটে আমাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হলো। একটা ক্ষীণ ধারণা হয়েছিল হয়তো আমাকে ছেড়ে দেয়া হবে। কারণ জেলখানায় ৬ মাস পরপর নতুন আটকাদেশ দিতে হয়। একটি অর্ডিন্যান্সের মেয়াদ ৬ মাস হলে নতুন নির্দেশ না দিয়ে ৬ মাসের বেশি আটক রাখা যায় না। আমার সেদিন ছিল ৬ মাস পরে আদেশ দেবার আরেক ৬ মাসের শেষদিন। ৬ মাসের শেষ দিনে জেল গেটে ডাকলে অনেকেরই ধারণা হয়–ঐ রাজবন্দিকে মনে হয় ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। আমার ক্ষেত্রে হলো আরেক নতুন নাটক।
জেল গেটে গিয়ে দেখলাম উচ্চপদস্থ পুলিশের কর্মকর্তারা বসে আছেন। সাথে আমার অ্যাডভোকেট রায়বাহাদুর রমেশ তালুকদার। তাঁরা জানালেন-পূর্ব বাংলার সরকার আমাকে ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে একটি শর্ত আছে। শর্ত হচ্ছে, জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে আমার বাড়ি বা অন্য কোথাও যাওয়া চলবে না। পুলিশ আমাকে সাথে করে পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে পৌঁছে দিয়ে আসবে। আমাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে ভারতে।
অ্যাডভোকেট রমেশ তালুকদার অনেক কাকুতি মিনতি করলেন। বললেন-আমার আত্মীয়-স্বজনের সাথে নাকি তাঁর কথা হয়েছে। আমি জেলে আসায় আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। জেলখানায় পড়াশোনা করা সম্ভব নয়। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় প্রাইভেট পরীক্ষা দেয়া সম্ভব নয়। তিনি আরো বললেন, এ ব্যাপারে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের চাচা খান সাহেব মোশাররফ হোসেনের সাথেও কথা বলেছেন। এ ব্যবস্থা নাকি তিনিই করেছেন।
একথা আংশিক হলেও সত্য ছিল। ১৯৪৯ সালের শেষের দিকে খান সাহেব আমার সাথে ঢাকা জেলে দেখা করতে এসেছিলেন। সাথে ছিল আমার ছোট কাকা। আমার নওয়া কাকা ও ছোট কাকা টুঙ্গীপাড়া থানার পাটগাতীতে ডাক্তারি করতেন। ছোট কাকা টুঙ্গীপাড়ার শেখ পরিবারের পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন। আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল গভীর এবং সকল প্রকার জাত-পাত ও সম্প্রদায়ের গণ্ডি পেরিয়ে। নাইলে খান সাহেব আমার সাথে দেখা করতে আসতেন না। পাকিস্তান আমলে আত্মীয়-স্বজনের পক্ষে রাজবন্দিদের সাথে দেখা করা দুঃসাধ্য ছিল। সেকালে পাকিস্তান সরকারের একমাত্র নীতি ছিল কাউকে বিশ্বাস না করা। এই নীতির ফলে অনেকে আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা করতে এসে গ্রেফতার হয়ে গেছে। ঢাকা জেলে সেবারের প্রায় ৫ বছরের জেল জীবনে বাইরের কারো সাথে দেখা করার সুযোগ হয়েছিল আমার মাত্র তিনবার।