আমার বাবা শিক্ষক ছিলেন। বইও লিখতেন। হঠাৎ বই লেখার জন্যে তিনি ১৯৩৯ সালে ঢাকায় আসেন। আমিও ঢাকায় এলাম। তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছিল যুদ্ধ নিয়ে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহেরুর মতৈক্য হচ্ছে না। এ সময় সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েও সভাপতির পদ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করে সুভাষচন্দ্র বসু ঢাকায় আসেন। আমাদের বাসা ছিল তকালীন দয়াগঞ্জ রোডে। ১৩ নম্বর বাড়িতে আমরা থাকতাম। একদিন দেখলাম সুভাষচন্দ্র বসুর মিছিল যাচ্ছে। তিনি যাচ্ছিলেন শক্তি ঔষধালয় দেখতে। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে তিনি মিছিল করে গেলেন। এর পরে ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণ করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ঢাকায় তখন যুদ্ধের খবর নিয়ে। প্রতিদিন একটি টেলিগ্রাম বের হতো। টেলিগ্রামটির নাম ছিল ‘অবন্তিকা’।
যুদ্ধের জন্যে আমরা ঢাকা থেকে বাড়ি চলে যাই। বাড়িতে পড়াশোনা হলো না। সেই কাহিনী আমার জীবনের গল্পের মতো। হঠাৎ একদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে ডেকে তুললেন মা। বাড়ির প্রায় সকলে ঘুমিয়ে। মা বললেন, হাত-মুখ ধুয়ে নাও। বিকেলে বরিশালের কলসকাঠি যেতে হবে। বাড়িতে পড়া হবে না। দূরে দেখলাম দাঁড়িয়ে নৌকার মাঝি। মাঝির মাখায় আমার স্যুটকেস।
আমার চোখে জল আসছিল। আগের রাতে বাড়িতে নাটক হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর। আমি অভিনয় করেছি। ভেবেছি ভোরবেলা সকলের সাথে দেখাশুনা হবে। শুনব নিজের অভিনয়ের কথা। না, সব ভেস্তে গেল। মার হাতে নারকেল তেল। মা বললেন, মুখে তোমার নাটকের মেক-আপ আছে। মুখে নারকেল তেল মাখো। তারপর মুখ ধুয়ে ফেলো। আমার চোখে জল। আমি কলের পুতুলের মতো সব করলাম। তারপর রওনা হলাম। বাড়ির সামনে সড়ক। তারপর সুবিস্তীর্ণ মাঠ। মাঠের পরে কচুরিপানা। এখানে নৌকা। নৌকা যাবে স্টিমার স্টেশন পাটগাতি। স্টিমার আসবে খুলনা থেকে। ঐ স্টিমারে আমাকে বরিশাল যেতে হবে।
আমি হাঁটছি আর হাঁটছি। পিছনে তাকাচ্ছি। শ্বেতশুভ্র কাপড়ে আমার মা তাকিয়ে আছেন, এক সময় চোখের কোণ থেকে মা হারিয়ে গেলেন। আমি নৌকায় উঠলাম। সেদিন যেমন করে বাড়ি ছেড়েছিলাম, তেমন করে আর আমার বাড়ি ফেরা হলো না।
চলে গেলাম বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ থানার কলসকাঠিতে। ভর্তি হলাম কলসকাঠি বরদাকান্ত মুক্তাকেশী একাডেমিতে। এই কলসকাঠিতে এসেই হয়তো আমার ভবিষ্যৎ জীবন নির্ধারিত হয়ে গেল। স্কুল জীবন থেকেই ধারণা ছিল বড় একটা কিছু হতে হবে। অনেক সময় ভেবেছি ভালো শিক্ষক হব, গবেষক হব। একটির পর একটি বিষয়ে থিসিস করব এবং ডক্টরেট হব। কাকা ডক্টরেট বলে ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল ডক্টরেট হতেই হবে। সুবোধ বালকের মতো লেখাপড়া করতে হবে এবং শিক্ষাবিদ হিসাবে খ্যাতি লাভ করতে হবে। কিন্তু কলসকাঠিতে এসে সবই যেন পাল্টে গেল।
এই কলসকাঠির একটি ইতিহাস আছে। কলসকাঠিতে এক সময় স্টিমার স্টেশন ছিল। ইংরেজিতে স্টেশনের নাম ছিল কলুষকঠি। তাহলে কি কলসকাঠিতে কলুষিত হবার মতো কোনো ঘটনা ঘটেছিল? কলসকাঠিতে ১৩ ঘর জমিদার ছিল। জমিদারদের বাগানবাড়ি ছিল, ছিল ছোটখাটো চিড়িয়াখানাও। আজ থেকে এক-দেড়শ’ বছর আগে প্রিন্টিং প্রেস ছিল। এই জমিদারদের অনেক ভবনের কক্ষের সংখ্যা কোনোদিনই হিসাব করা যায়নি। অনেক জমিদারের বাড়ির ভেতরে ছোট ছোট পিলার আছে। লোকে বলে প্রজাদের ধরে এনে খুন করে রাতারাতি কবর দিয়ে ঐ পিলার তৈরি করা হয়েছে। তবে এই জমিদারেরা লোক দেখানো জনকল্যাণের জন্যেও কিছু কিছু কাজ করেছে। স্কুল করেছে নিজ খরচে। ডাকঘর দিয়েছে। গ্রামে ইট বিছানো সড়ক করেছে। তবে আমি যখন কলসকাঠিতে গিয়েছি তখন সবকিছুই অতীতের স্মৃতি মাত্র।
কলসকাঠির একটি ঐতিহ্য ছিল। এই ঐতিহ্য হচ্ছে রাজনীতির। কংগ্রেসের প্রথম যুগে গ্রাম গ্রামান্তরে নেতা ছিলেন জমিদার শ্রেণির লোক। এক শ্রেণির জমিদার ও তহশিলদার কংগ্রেসকে সহযোগিতা কত এবং অর্থ যোগাত। জমিদার সন্তানেরা নির্বিরোধ বিলাসী জীবনযাপন করত। রাজনীতি করায় তাদের খুব অসুবিধা ছিল না। এছাড়াও ছিল এ সকল এলাকায় এককালের গুপ্ত বিপ্লবী দলের প্রভাব। তখন কমিউনিস্ট পাটি গঠিত হয়েছে ঐ এলাকায়। কলসকাঠি স্কুলে ভর্তি হয়ে আমার প্রথম দেখা হলো ফরওয়ার্ড ব্লকের ছাত্রদের সাথে। ফরওয়ার্ড ব্লক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ওদের সাথে যখন আমার দেখা হলো, তখন সুভাষচন্দ্র বসু এক রহস্যময় পুরুষ। তিনি ভারত থেকে ব্রিটিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গেছেন। জার্মানিতে। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ভারতীয় যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে নতুন সেনাবাহিনী গড়বেন এবং ভারতকে স্বাধীন করবেন। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই সুভাষচন্দ্র বসু দেশ ত্যাগ করেছিলেন। তিনি যুদ্ধের প্রথম দিকেই ব্রিটিশকে আঘাত করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু গান্ধী ও নেহেরু সে প্রস্তাবে রাজি হননি। অথচ ১৯৪২ সালে ঐ প্রস্তাবেই রাজি হলেন গান্ধী ও নেহেরুর নেতৃত্বের কংগ্রেস। ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট মুম্বাইতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন বসল। ব্রিটিশ সরকারকে আলটিমেটাম দেয়া হলো ভারত ছাড়ার। এই আন্দোলনের নাম হলো ‘কুইট ইন্ডিয়া’ অর্থাৎ ভারত ছাড়ো আন্দোলন। গান্ধীজীর শ্লোগান হলো ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’। গান্ধী, জওহরলাল, মাওলানা আজাদসহ কংগ্রেসের সকল নেতারা ঐ দিনই গ্রেফতার হয়ে গেলেন। এর প্রতিক্রিয়া হলো সারা ভারতবর্ষে। সে ঢেউ কলসকাঠিকেও তছনছ করে দিল। আমার জীবনও পাল্টে গেল।