তৃতীয় অনশন অর্থহীনভাবে প্রত্যাহার হওয়ায় আমাদের মনে ভিন্ন প্রশ্ন দেখা দিল। দেখা গেল কমিউনিস্ট পার্টি নতুন করে অনশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। শুধু অপেক্ষা করছে একটা অজুহাতের। সে অজুহাত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে সৃষ্টি করলেন নাদেরা বেগম। শুনলাম নাদেরা বেগম ও দেবপ্রসাদ মুখার্জি নতুন নির্দেশ নিয়ে এসেছে জেলখানায়। অর্থাৎ জেলের আন্দোলন তীব্র করতে হবে। তাই চতুর্থবারের জন্য অনশন শুরু হলো ঢাকা জেলে ১৯৪৯ সালের ২ ডিসেম্বর।
শেষ পর্যন্ত ডিসেম্বরের অনশন ধর্মঘটে আমাদের যাওয়া হয়নি। দলের কঠিন নির্দেশ হলো–কমিউনিস্ট পার্টির অনশনের সিদ্ধান্ত হটকারী। এই কৌশল আদৌ রাজনৈতিক কৌশল নয়। এই অনশন ধর্মঘট আদৌ রাজনৈতিক দিক থেকেও সঠিক নয়। তবুও আমরা প্রথম দিকে এই অনশনে ছিলাম। আমরা অর্থাৎ আরএসপি’র আমি ও নিতাই গাঙ্গুলী। প্রথমে কথা হয়েছিল মহিলা ওয়ার্ডে হামলার জন্য ৭ দিন অনশন করা হবে। দাবি মানা না হলে অনশন ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়া হবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কমিউনিস্ট পার্টি তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনশন অব্যাহত রাখে। কারো সাথে আলোচনা না করেই এ অনশন ৫২ দিন চলেছিল এবং এই অনশন শেষ হয় ১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে।
১৯৪৯ সালে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল টাঙ্গাইলের উপনির্বাচন। এই আসনে এককালে নির্বাচিত হয়েছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মাওলানা ভাসানীর নির্বাচন বাতিল হয়ে যায়, তিনি নির্বাচনের হিসাব দাখিল করেননি বলে। ১৯৪৯ সালে এই আসনে উপনির্বাচনে বিরোধী দলের প্রার্থী হলেন মোহাম্মদ শামসুল হক। শামসুল হক মুসলিম লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করে জয়লাভ করেন। কিন্তু তার জয়লাভও কোনো কাজে আসেনি। তার নির্বাচনও ট্রাইব্যুনাল বাতিল করে দেয়। আমাদের কাছে ছিল এ এক দারুণ খবর। মাসের পর মাস অনশনের মধ্যে এ খবর ছিল আশার খবর। পাকিস্তান সৃষ্টির দু’বছরের মধ্যে পাকিস্তানের উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয় রাজনৈতিক দিক থেকে ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এই শামসুল হক আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্মলগ্নে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন।
১৯৫০ সালের জেল জীবন শুরু হলো এক নতুন প্রেক্ষিতে। মনে হলো ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নীতির পরিবর্তন হচ্ছে। এছাড়া জেলখানায় অনশন করার মতো অবস্থাও কারো ছিল না। দীর্ঘদিন অনশনের ফলে প্রায় সকলেরই স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গিয়েছিল। এরমধ্যে একদিন দিনাজপুরে ক্ষেমেশ চ্যাটার্জি পত্রিকা হাতে নিয়ে সোরগোল শুরু করেছেন। ক্ষেমেশ চ্যাটার্জি বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির লোক (রিভলুশনারি কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-আরসিপিআই)। তাঁর নেতা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারের সৌমেন্দ্র নাথ ঠাকুর। সৌমেন্দ্র ঠাকুর লেনিনের সমসাময়িক ছিলেন। তিনি সপ্তম কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের প্রেসিডিয়ামের সদস্য ছিলেন। স্ট্যালিনের সাথে মতের মিল না হওয়ায় তিনি ভারতে এসে আরসিপিআই গঠন করেন। তারই দলের ক্ষেমেশ চ্যাটার্জি মাত্র কিছুদিন আগে দিনাজপুর থেকে ঢাকা জেলে এসেছিলেন। ক্ষেমেশ বাবু অনশনে অংশগ্রহণ করেননি। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির ঘোরতর বিরোধী।
ক্ষেমেশ বাবুর হাতে স্টেটসম্যান পত্রিকা ছিল। ঐ পত্রিকা পড়েই তিনি চিৎকার করছিলেন। খবরটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি এশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে আপাতত সরকার বিরোধী আন্দোলন স্তিমিত করার নির্দেশ দিয়েছে। ক্ষেমেশ বাবুর ধারণা হচ্ছে-নিশ্চয়ই এশিয়ায় কোনো বড় ধরনের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। যে ঘটনায় সোভিয়েত ইউনিয়ন জড়িয়ে পড়তে পারে।
ক্ষেমেশ বাবু এই মন্তব্য করেছিলেন ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে। তার মন্তব্য সত্যে প্রমাণিত হলো জুন মাসে। জুন মাসে কোরিয়া সীমান্তে সংঘর্ষ শুরু হয়। উত্তর কোরিয়াকে সাহায্য সহযোগিতা করে সোভিয়েন ইউনিয়ন ও চীন। দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে দাঁড়ায় জাতিসংঘের নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পাশ্চাত্যের শক্তিবর্গ। এ যুদ্ধ তিন বছর স্থায়ী হয়েছিল।
এই ১৯৫০ সালে আরেক ঘটনা ঘটল হাইকোর্টে। আমি ঢাকা হাইকোর্টে আমার আটকাদেশের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলাম। জেলখানা থেকে আমার আবেদনপত্র লিখে দিয়েছিলেন দেবেশ ভট্টাচার্য। দেবেশ বাবু বিশিষ্ট আইনজ্ঞ। ময়মনসিংহে প্র্যাকটিস করতেন। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ময়মনসিংহের আদালতে আন্দোলনে গ্রেফতার ও দণ্ডিত ব্যক্তিদের পক্ষে মামলা করতেন। এটাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় অপরাধ। তাই বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাকে গ্রেফতার ও আটক রাখা হয়। দেবেশ বাবু পরবর্তীকালে ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি হন।
আমার আবেদপত্র হাইকোর্ট গ্রহণ করে। আমি কলকাতায় আমার আত্মীয়দের কাছে ভালো উকিল নিযুক্ত করার জন্য চিঠি লিখি। ঢাকায় তখন ওকালতি করতেন বর্মা প্রত্যাগত রায় বাহাদুর রমেশ তালুকদার। তাঁকে কলকাতায় ডেকে পাঠিয়ে ব্রিফ করে আমার মামলার জন্য নিয়োগ করা হয়। এ সকল খবর জেলখানায় খুব পাওয়া যেত না। শুধু জানতাম হাইকোর্টে আমার মামলার শুনানি হবে। আমার মামলা ছিল সেকালের পূর্ব বাংলার দ্বিতীয় মামলা। নিরাপত্তা বন্দি হিসাবে প্রথম মামলা হয়েছিল দবিরুল ইসলামের। সে মামলায় উকিল ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।