১৯৪৯ সালের ১১ মার্চ ঢাকা জেলে অনশন শুরু হলো। অনশন টিকল না। পূর্ববাংলা সরকারের মৌখিক বিশ্বাসে ১৫ মার্চ অনশন প্রত্যাহার করা হলো। পূর্ব বাংলার রাজবন্দিদের জীবনে এক ভয়াবহ নতুন নির্যাতন নেমে এল।
ব্রিটিশ আমলে জেলখানায় রাজবন্দিদের বছরের পর বছর সংগ্রাম করতে হয়েছিল নিজেদের সম্মান ও মর্যাদার জন্য। শেষ দিকে ব্রিটিশ সরকার তাদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলে। ১৯৪০ সালে প্রণীত হয়েছিল সিকিউরিটি প্রিজনার্স রুল ১৯৪০। এই বিধান বলেই জেলখানায় বিশেষ সুবিধা দেয়া হতো রাজবন্দিদের।
১৯৪৭ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের সাথে সাথে পাকিস্তান সরকার বিনা কারণে ধরপাকড় এবং বিনা বিচারে আটক রাখার আইন উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিল ব্রিটিশের কাছ থেকে। তেমনি ১৯৪০ সালের রাজবন্দিদের জন্য প্রণীত রুলসও পেয়েছিল। ১৯৪৯ সালের মার্চের অনশন ধর্মঘটের পর পূর্ববঙ্গ সরকার রাজবন্দিদের ঐ আইন বাতিল করলেন। মৌখিক আশ্বাসকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাজবন্দিদের সুবিধাগুলো কেড়ে নিলেন।
এবার রাজবন্দিরা পরিণত হলো সাধারণ কয়েদীতে। কোনো মর্যাদা নয়। তাদের সাথে আচরণ শুরু হলো চোর-ডাকাতের মতো। এ সকল অপরাধে যারা গ্রেফতার হয় বা যাদের সাজা হয় তাদের তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে জেলে রাখা হয়। এই শ্রেণির প্রাপ্তি নির্ভর করত সামাজিক-পারিবারিক অবস্থান, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং পেশার ওপর। বিনা বিচারে আটক রাজনীতিকদের প্রশ্নে এ ধরনের কোনো শ্রেণি বিভাগ ছিল না ব্রিটিশ আমলে। এ কাজটি করলেন পাকিস্তান সরকার ১৯৪৯ সালে।
আমাদের হাতে গোনা কয়েকজনকে দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দেয়া হলো। বাকি সবাইকে পরিণত করা হলো তৃতীয় শ্রেণির কয়েদীতে। অর্থাৎ থালা-বাটি কম্বল জেলখানার সম্বলের অধিকারী বানানো হলো তাদের। অথচ এই অনশনের আগে তাদের সকল সুযোগ-সুবিধা ছিল। খাট, লেপ, তোষক, মশারি, জুতো, জামা, স্যুট, ব্রাশ, সাবান, পেস্ট, কোট, উন্নতমানের খাবার ব্রিটিশ প্রণীত বিধি অনুযায়ী সব কিছুই ছিল। ১৯৪৯ সালের মার্চের প্রথম অনশন ধর্মঘটের পর এদের সামনে এদের খাট-তোষক, লেপ নিয়ে যাওয়া হলো। পাঠানো হলো থালা বাটি কম্বল। আমাদের অন্য ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা পৃথক হলাম। সেই পৃথক হবার পরে অনেকের সাথেই আর আমার আজো দেখা হয়নি। এদের মধ্যে অধিকাংশই পরবর্তীকালে দেশান্তরী। আর এদেশে যারা ছিল তারা লোকান্তরিত বা রাজনীতিতে আদৌ নেই।
সুতরাং শুধুমাত্র কমিউনিস্ট পার্টির তত্ত্ব বা কৌশল নয়। রাজবন্দিদের হৃত অধিকার ফিরিয়ে আনার দাবিতেই আবার আন্দোলনে যেতে হলো। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দ্বিতীয় অনশন শুরু হলো মে মাসে। সে মাসে অনশন ধর্মঘট শুরু হবার পূর্বে ঢাকায় আন্দোলন হচ্ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম বেতনভুক্ত কর্মচারীদের নিয়ে। এপ্রিল মাসে এ আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। এই আন্দোলনে শরিক হবার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ৬ জনকে ৪ বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার, ১৫ জনকে হল থেকে বহিষ্কার। ৫ জনের ১৫ টাকা ও ১ জনের ১০ টাকা জরিমানা করা হয়।
১৫ টাকা যাঁদের জরিমানা হয় তাদের তালিকায় ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ আন্দোলনের সময় গ্রেফতার হন আব্দুল মতিন, এনায়েত করিম, খালেক নওয়াজ, আজিজুর রহমান, বাহাউদ্দিন চৌধুরী ও নিতাই গাঙ্গুলী। পরবর্তীকালে নিতাই গাঙ্গুলী ব্যতীত সকলকেই মুক্তি দেয়া হয়। ঢাকা জেলা বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল আরএসপি’র সম্পাদক নিতাই গাঙ্গুলী আমাদের সাথেই থেকে গেলেন। তিনি আমাদের সাথে দ্বিতীয় অনশনে অংশ নিলেন।
দ্বিতীয় অনশনের সময় নগ্নরূপ প্রকাশিত হলো মুসলিম লীগ সরকারের। পূর্ববাংলা সরকার একটি প্রেসনোট দিল জেলখানায় অনশন সম্পর্কে। প্রেসনোটের মর্মার্থ হলো–ব্রিটিশ আমলে রাজবন্দিরা দেশপ্রেমিক ছিল তাই তাদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেয়া হতো। এখন আর তারা দেশপ্রেমিক নয়। সুতরাং সে সুবিধা দেয়া যাচ্ছে না।
এ ধরনের প্রেসনোটের অন্যতম কারণ হলো–প্রকৃতপক্ষে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্রিটিশবিরোধী তেমন কোনো আন্দোলন করেনি। পূর্ববাংলায় যারা সরকারে এসেছিলেন তাদের মধ্যে কেউ কোনোদিন জেল খাটেনি। রাজবন্দিদের সম্মান বা মর্যাদা সম্পর্কে এদের কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। একমাত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহারের কিছুটা বাম ঘেঁষা গন্ধ ছিল। আর সকলেই ছিল উকিল-মোক্তার এবং চাকরিজীবী। রাজনীতি এদের মুখ্য পেশা ছিল না। শুধু ছিল অন্ধ কংগ্রেস এবং বাম রাজনীতির বিরোধিতা।
২৪ দিন পর দ্বিতীয় অনশন ধর্মঘট শেষ হলো জেলমন্ত্রী মফিজউদ্দীন, মুসলিম লীগ নেতা ফকির আবদুল মান্নান ও কংগ্রেস নেতা মনোরঞ্জন ধরের সাথে আলোচনার পর। তবে সে আলোচনা কোনো কাজে আসেনি।
আমাদের অনশন ধর্মঘট রাজবন্দিদের দাবি আদায়ের নামে হলেও মুখ্যত ছিল তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির ভুল কর্মপন্থার ফল। ফলে তৃতীয়বারের মতো আবার অনশন শুরু হলো আগস্ট মাসে। এ অনশন স্থায়ী হয় ৪০ দিন। এবারও কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়।
আমি কমিউনিস্ট পার্টি করি না। ভিন্ন দলের লোক। তাদের সমর্থনে বার বার অনশন করছি। শরীর ভেঙে গেছে। তাই প্রতিবারই অনশন ধর্মঘট প্রত্যাহারে সময় আমার সাথে মতানৈক্য হতো। ধর্মঘট প্রত্যাহারের বিরোধী ছিলেন–দিনাজপুরের ঋষিকেশ ভট্টাচার্য, কিশোরগঞ্জের নগেন সরকার, চট্টগ্রামের আব্দুস সাত্তার। আমি এদের পক্ষে থাকতাম।