এই ঐতিহ্য ধরে ঢাকা জেলের কর্মকর্তারা আমাদের সাথে তেমন আচরণ করতেন। ইতোমধ্যে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার হয়ে এলেন কমিউনিস্ট পার্টির ফরিদ খান। জেল কর্তৃপক্ষ কিছুতেই তাঁকে আমাদের ওয়ার্ডে দিলেন না। একদিন তাকে ভিন্ন সেলে রাখা হলো। বলা হলো–আপনি মুসলমান, আপনি হিন্দু বন্দিদের সাথে কেন থাকবেন? আপনার জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা করা হবে। জবাবে ফরিদ খান বললেন, আমি মুসলমান বা হিন্দু নই। আমি কমিউনিস্ট। আমাকে অন্যান্য রাজবন্দিদের সাথেই থাকতে দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত ফরিদ খানকে আমাদের ওয়ার্ডেই পাঠিয়ে দেয়া হয়।
ঢাকা জেলে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে দীর্ঘ সময় লাগে। পরবর্তীকালে অসংখ্য মুসলমান কমরেড জেলে আসতে থাকায় এক সময় পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হয়। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে শুরু করে ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর।
তবে জেলের সমস্যা আদৌ সাম্প্রদায়িক সমস্যা ছিল না। মুখ্য ছিল রাজনৈতিক সমস্যা। সেকালে রাজবন্দি হিসাবে যারা ছিল তাদের মধ্যে শতকরা ৯০ জনই কমিউনিস্ট পার্টির। এছাড়াও ছিল কংগ্রেস, আরএসপি, ফরোয়ার্ড ব্লক, হিন্দু মহাসভার সদস্য। আমরা সকলেই রাজনীতি করি বলে এই রাজনীতির ছাপ পড়েছিল জেলখানায়। সে রাজনীতির উদ্যোক্তা ছিল মুখ্যত কমিউনিস্ট পার্টি। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি আন্দোলনের নতুন কৌশল নিয়েছে। ভারত বিভক্ত হলেও কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়নি। তাই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কৌশল প্রয়োগ ছিল পাকিস্তানের জন্যে।
ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির বক্তব্য হচ্ছে ব্রিটিশ চলে গেলেও ভারত বা পাকিস্তান প্রকৃতার্থে স্বাধীন হয়নি। তাই ক্ষমতাসীন সরকারকে আঘাতের পর আঘাত করে ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে। জেলখানায় কৌশল হবে জেলখানার যে কোনো ছুতায় সঙ্কট সৃষ্টি করতে হবে। জেলখানার সঙ্কটে অঘটন ঘটলে বাইরে তার প্রতিক্রিয়া হবে। মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করবে। সরকারকে আঘাত করবে। সরকারের পতন ঘটবে।
কিন্তু জেলখানায় এ কাজটি কী করে করা যাবে? বলা হলো–জেল কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি দাওয়া পেশ করো। দাবি মানা না হলে অনশন ধর্মঘট করো। আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে অনশনকে ভিত্তি করে।
আমাদের দল বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল আরএসপি। আমাদের দলের মূল্যায়ন হলো, কমিউনিস্ট পার্টির এ সিদ্ধান্ত ভুল। হঠকারী কৌশল। দেশ স্বাধীন হলেও সমাজ পরিবর্তন করা না গেলে সাধারণ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না–এ বক্তব্য সঠিক। কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হবার পরপরই এ তত্ত্ব গ্রহণ করার মতো মানসিক প্রস্তুতি হয়নি। এ ছাড়া এ আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাবার মতো শক্তিশালী শ্রেণি সংগঠনের অভাব আছে। আর সমগ্র উপমহাদেশে তখন সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি ভয়াবহ। সুতরাং কমিউনিস্ট পার্টির এ তত্ত্ব আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। জেলখানার কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার সদস্যদের এ আন্দোলনে যাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু জেলখানায় রাজবন্দিদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর সর্বকনিষ্ঠ রাজবন্দি হিসেবে জেলে এসেছিল প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা অনিল মুখার্জির ভাইয়ের ছেলে অতীশ মুখার্জি। আমি ঢাকা জেলে আসার পূর্বে সে মুক্তি পায়। আমার সাথে পরবর্তীকালে আরো দু’জন বয়সে কম রাজবন্দি ছিল। এদের মধ্যে একজন হচ্ছেন মুন্সীগঞ্জের শফিউদ্দীন আহমদ যিনি সাংবাদিক হিসাবে পরিচিত। আর একজন খুলনার আনোয়ার হোসেন। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজবন্দি অবস্থায় জেল পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। আমার সিদ্ধান্ত হলো অন্য সবাই অনশন করলে আমার পক্ষে ভাত খাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং আমিও অনশনের সিদ্ধান্ত নিলাম।
আমাদের অনশনের পূর্বে কয়েকটি ঘটনা ঘটল। আমাদের প্রতিনিধি কমরেড জ্যোতি ব্যানার্জিকে ঢাকা জেল থেকে অন্য জেলে পাঠানো হলো। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর সাথে আমার দেখা হয়নি। আমাদের নতুন প্রতিনিধি হলেন রণেশ দাশগুপ্ত। আমাদের পক্ষ হয়ে তিনি জেল কর্তৃপক্ষের সাথে দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা করতেন।
এর মধ্যে একদিন জেলখানার সবচেয়ে বড় কর্মকর্তা সার্জন জেনারেল কর্নেল টিডি আহমেদ জেলখানায় এলেন। তিনি নাকি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজনস (আইজি) অর্থাৎ কারাগারসমূহের মহাপরিদর্শক। কর্নেল টিডি আহমদ আমাদের ওয়ার্ডে এসে আমার দিকে এগিয়ে এলেন, বললেন–এই বাচ্চা, তুমি এখানে কেন? সুপারিন্টেডেন্টকে বললেন, রেকর্ড নিয়ে এসো। একে রিলিজ করে দাও। একজন ডেপুটি জেলার এগিয়ে এসে বললেন, স্যার উনি রাজবন্দি। এদের বিচার নেই। জামিন নেই। তাই মুক্তি দেয়া যাবে না। কর্নেল টিডি আহমদ বললেন, ইজ ইট পাকিস্তান?
আমাদের অনশনের দিন নির্ধারিত হলো। ১৯৪৯ সালের ১১ মার্চ। ঐ দিন পশ্চিমবাংলা ও পূর্ববাংলায় কমিউনিস্ট পার্টির রোড ইউনিয়নের ডাকে রেল ধর্মঘট। আমার কাছে এ সিদ্ধান্ত সঠিক মনে হলো না। এমনিতে আমাদের ভারতের দালাল বলা হয়, তারপরে একই দিনে দু’দেশে হরতাল ডাকা আদৌ সঠিক কি!
কমিউনিস্ট পার্টির এক বন্ধুর সাথে আলোচনা করলাম। নাম নরেশ চক্রবর্তী। বাড়ি কুমিল্লা। এক সময় আরএসপি করতেন। পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টিতে গিয়েছেন। তিনি আমার কথা শুনে হেসে উড়িয়ে দিলেন। বললেন, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ শ্লোগান দিই। আমাদের এত ভয় কেন? আমি শুধু বুঝতে পারলাম না–ঢাকা জেলের অনশনের সাথে কলকাতার রেল শ্রমিকদের আন্দোলনের সম্পর্ক কী। জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে নরেশ বাবু কলকাতায় যান। ১৯৭১ সালে শুনেছি নাকতলায় আছেন। সিপিআই(এম) এর সদস্য।