সেকালের কথা মনে হলে আমার কুমিল্লার সেই সেকেন্দার আলীর কথা মনে পড়ে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আর্দালিকে প্রহারের দায়ে অভিযুক্ত সেকেন্দার আলী। ফজর আলীর নেতৃত্বে কাজ করে। দিন আনে দিন খায়। ৬ মাস হয়ে গেছে জেলখানায় এসেছে। প্রতিরাতে চোখের জল ফেলে স্ত্রী-পুত্রের জন্য। স্ত্রীর নাম ছমিরন বিবি। সপ্তাহে সপ্তাহে স্ত্রীকে চিঠি লিখত সেকেন্দার আলী। চিঠির লেখক আমি। সেকেন্দার আলীর বড় ভয়– দীর্ঘদিন অনুপস্থিতির ফলে স্ত্রী যদি ভিন্ন ঘরে চলে যায়! কী হবে তার উপায়? জেলখানায় সেকেন্দার আলীর সাথে তারপর বেশিদিন দেখা হয়নি। আমরা অনশন করার ফলে আমাদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। শুনেছি মাস ছয়েক পর সেকেন্দার আলীকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। আমার মুক্তি পেতে পেতে বছর পাঁচেক। তারপর অনেকবার জেলে যাওয়া-আসা করেছি। কুমিল্লা গিয়েছি অসংখ্যবার। ফজর আলী, সেকেন্দার আলী ও অম্বর আলীর খোঁজ করা হয়নি।
ঢাকা জেলে প্রথম রাতে ঘুম ভাঙল এক বন্দির ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নায়। উজ্জ্বল এক তরুণ ভারতীয় বিমানবাহিনীর পাইলট। বাড়ি মানিকগঞ্জের জামিয়তা। ঢাকায় আসা-যাওয়া ছিল দীর্ঘদিন ধরে। প্রেমে পড়েছিলেন এক গায়িকার। গায়িকার দু’বোন তখন নজরুল সঙ্গীত গাইতেন ঢাকা বেতারে। এই প্রেমের উপাখ্যান শুরু ভারত বিভাগের পূর্বে।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হলো। গায়িকা দুই বোন ঢাকায় ওয়ারীতে থেকে গেলেন। বিমানবাহিনী পাইলট জামিয়তার শচীন রায় অপসন দিয়ে ভারতীয় বিমানবাহিনীতে যোগ দিলেন। ভারত ভাগের পরেও শচীন রায় দু’একবার ঢাকায় এসেছেন। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ শুরু হওয়ায়। শচীন রায়ের কাছে শুনেছি সে নাকি ভারতীয় বিমান নিয়ে কাশ্মীর ফ্রন্টে এক দফা যুদ্ধ করেছে। তারপর এসেছিল ঢাকায় বেড়াতে। পাকিস্তান সরকার তাকে গ্রেফতার করেছে। কোনো মামলা দেয়নি। আটক রেখেছে অনির্দিষ্টকালের জন্যে।
শচীন রায় জানে না সে কবে মুক্তি পাবে। কোথায় যাবে? কিভাবে যাবে? যাদের জন্যে ঢাকা এসেছিল তারাও দূরে সরে গেছে। কারণ তখন পাকিস্তানে চলছে ভয়াবহ এক ভয়ের রাজত্ব। কবে কিভাবে শচীন রায় জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়েছে তা জানি না। শুনেছি সে দেশ ছাড়েনি। জামিয়তা ঘর বেঁধেছে। তবে সে খবরও দীর্ঘদিন পূর্বের।
ঢাকা জেলে ঘুম ভাঙার সাথে সাথে ধরণী বাবুর কণ্ঠ শোনা গেল। ঢাকা জেলার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ধরণী রায় রেল শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলন করেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে প্রথম থেকে ছিলেন। গেফতার হয়ে এসেছিলেন অনেকের সাথে। প্রথমবার মুক্তি পেলেও দ্বিতীয়বার তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়নি। দেখা হয় রণেশ দাশগুপ্তের সাথে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভভদ্রলোক রণেশ দাশগুপ্ত। উচ্চকণ্ঠে কথা বলেন না। নিজের মত কখনও অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চান না। সকলেই তাঁর বন্ধু। কারণ শত্রু হবার উপায় নেই। দেখা হলো বরিশালের জ্যোতি ব্যানার্জির সাথে। ডাক নাম নুটু ব্যানার্জি। বরিশালের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। লেখাপড়া করেন। দীর্ঘকাল পাকিস্তানের জেলে ছিলেন। মুক্তি পেয়ে দেশান্তরী হলেন। পরবর্তীকালে শিক্ষকতা করতেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ঢাকা জেলে দেখা হলো হরিগঙ্গা বসাকের সাথে। আদি বাড়ি ঢাকার বনগ্রাম লেনে। রাজনীতি করতেন আগরতলায়। আগতলায় ত্রিপুরা কংগ্রেসের নেতা ছিলেন। তার গ্রেফতার এবং বন্দি জীবন এক আশ্চর্য ঘটনা।
ভারত বিভাগের সময় একটি কাউন্সিল করা হয়েছিল। কাউন্সিলের নাম ডিভিশনাল কাউন্সিল। এই কাউন্সিলে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি থাকত। ত্রিপুরা তখন দেশীয় রাজ্য। ত্রিপুরা কংগ্রেসের নেতা হিসাবে হরিগঙ্গা বসাক এ ডিভিশন কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। তাই তাঁর বিরুদ্ধে রাগ ছিল পাকিস্তান সরকারের। ১৯৪৮ সালে অসুস্থ মাকে দেখার জন্য হরিগঙ্গা বসাক আগরতলা থেকে ঢাকা এসেছিলেন। তখন তাকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর গ্রেফতারের নির্দেশ তারিখ ছিল ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাইয়ের। অথচ তিনি ঢাকা এসেছিলেন ২৯ জুলাই। এ নিয়ে হরিগঙ্গা বাবু অনেক লেখালেখি করেছিলেন। কিন্তু কোনো কাজে আসেনি। ১৯৫০ সালে মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন হরিগঙ্গা বসাক ঢাকা জেলে। যারা আগরতলা গেছেন তারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন সেই শহরের একটি সড়কের নাম হরিগঙ্গা বসাক সড়ক। তখন জেলখানার রাজনীতির একটি বিশেষ দিক ছিল। ব্রিটিশ আমলে যাঁরা জেলে ছিলেন তাদের অধিকাংশই ছিলেন কংগ্রেসের নেতা ও কর্মী। কংগ্রেস, আরএসপি, ফরোয়ার্ড ব্লক, কমিউনিস্ট পার্টি ও কংগ্রেস সমাজতান্ত্রিক দল সিএসপির সদস্য থাকলেও সকলেই আবার কংগ্রেসের সদস্য ছিল। জেলখানায় তারা কংগ্রেসি বলে পরিচিত ছিল। অধিকাংশ কংগ্রেস নেতা ও কর্মী ছিলেন হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আসা। ব্রিটিশ সরকার এই সকল রাজবন্দিদেরই ভারত স্বাধীন হবার আগে মুক্তি দিয়েছিল।
কিন্তু পাকিস্তানে সেই মুক্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই আবার রাজনৈতিক ধরপাকড় শুরু হয়। যারা গ্রেফতার হলেন তাদের অধিকাংশই এককালের কংগ্রেস কর্মী ও নেতা হলেও তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ ছিলেন বামদলের নেতা ও কর্মী। অধিকাংশই হিন্দু মধ্যবিত্ত ঘর থেকে আসা। তাই জেলখানার কর্মচারী ও কয়েদিদের কাছে নতুন রাজবন্দিদের নতুন কোনো পরিচয় হলো না। তাদের কাছে এরা কংগ্রেসি। এরা হিন্দু এবং এককালের পাকিস্তান-বিরোধী। তাদের ধারণা হলো পাকিস্তান-বিরোধী বলেই তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এ জন্যে পাকিস্তান সরকারকে তেমন দোষ দেয়া যায় না।