বরিশাল জেলে তখন নতুন নতুন বন্দি আসছে। প্রায় প্রতিদিনই নিরাপত্তা আইনে রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এদের মধ্যে অধিকাংশ বামপন্থী দলের সদস্য। তবে যারা গ্রেফতার হয়ে আসেন তাঁদের সকলের সাথে আমাদের দেখা হয় না। কারণ অধিকাংশ বন্দিকে তৃতীয় শ্রেণিতে রাখা হয়। রাখা হয় আমাদের চেয়ে দূরে। তাই তাঁদের সাথে দেখা হয় কদাচিৎ।
এর মধ্যে তিনজন বন্দি আমাদের এলাকায় এলেন। এঁরা হচ্ছেন–কমিউনিস্ট পার্টির নেতা নরেন্দ্রনাথ রায়, হিন্দু ছাত্র ফেডারেশনর প্রশান্ত দাশগুপ্ত এবং অন্যতম নেতা অজিত বসু। শুনেছি নরেন বাবু জীবিত নেই। প্রশান্ত দাশগুপ্ত’র সাথে দেখা হয়েছিল ১৯৭১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত স্টেশনে। তিনি বললেন–অনেক নির্যাতন সহ্য করলেও আপনারা জিতে গেলেন। অজিত বসুর কোনো খোঁজ আজো পাইনি। সেকালের পূর্ববাংলার জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে তাঁরা সকলেই দেশান্তরী হয়েছিলেন।
এই তিনজনের সাথে একই স্টিমারে বরিশাল থেকে ঢাকা এসেছিলাম ১৯৪৮ সালের অক্টোবরে। তখন স্টিমার ঘাট বাদামতলীতেই ছিল। ঢাকায় এমন ভিড় ছিল না। পুলিশ প্রহরায় ঢাকা জেলে এলাম ঘোড়ার গাড়িতে। এই ঘোড়ার গাড়ি ও বুড়িগঙ্গা নদীর এক দীর্ঘ স্মৃতি আছে আমার শৈশব জীবনের। বাবা তখন বই লিখতেন ঢাকায়। বিভিন্ন প্রকাশের সাথে চুক্তিতে বই লেখা। মূল লেখক বাবা হলেও বাজারে সেই বই বিক্রি হতো ভিন্ন নামে। আমরা তখন থাকতাম নারিন্দার ১৩ নম্বর দয়াগঞ্জ রোডে। সে সড়কের নতুন নাম শরৎগুপ্ত রোড। ঐ সড়ক থেকে স্বামীবাগের দিকে গেলে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কের রেল লাইন। ঐ রেল লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখনো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যেতাম। আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, এককালে রমনা কালীবাড়ি এলাকা অর্থাৎ রেসকোর্স ময়দানে এসে ঘোড়ার দৌড় দেখতাম। ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশন থেকে ৮ পয়সা অর্থাৎ দু’আনা ঘোড়ার গাড়িতে নারিন্দা যেতাম। বিকালে যেতাম বাবার বই’র এলাকা বাংলাবাজারে। সেখান থেকে বুড়িগঙ্গার তীরে করোনেশন পার্ক। করোনেশন পার্কে রাত ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বসে থাকতাম। সন্ধ্যার পরে বরিশাল থেকে স্টিমার আসত। আলোতে চিকচিক করতো বুড়িগঙ্গার জল। তবে বুড়িগঙ্গা বরাবরই বড় নিস্তরঙ্গ। বরিশালের স্টিমার বাদামতলীর ঘাটে ভিড়লে বাসায় ফিরতাম। সে ১৯৩৯ সালের কথা।
১৯৪৮ সালের অক্টোবরে বরিশালের স্টিমারে বাদামতলীর ঘাটে এলাম। আবার ঘোড়ার গাড়িতে উঠলাম। এবার নারিন্দার বাসা নয়, একেবারে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো পুরনো হাজতে। ঐ এলাকা থেকে পালিয়ে যাওয়া মুশকিল। আন্দামান থেকে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের ফিরিয়ে এনে পুরনো জেলে রাখা হয়েছিল। সে পুরনো জেল এখন সংস্কার করা হয়েছে।
১৯৪৮ সালের অক্টোবরে ঢাকা জেলে ঢুকে অবাক হলাম। বুঝতে শুরু করলাম পাকিস্তান কাকে বলে এবং কী প্রকার। উত্তরাধিকার সূত্রে পাকিস্তান সরকার অনেক কালাকানুন পেয়েছিল ব্রিটিশের কাছ থেকে। ঐ আইনে কোনো কারণ না দেখিয়ে যে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা যায়। আটক রাখা যায় অনির্দিষ্টকালের জন্যে। দেখলাম পাকিস্তান সরকার জন্মলগ্ন থেকেই এ আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার শুরু করেছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নয়, ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য পাকিস্তান সরকার যাকে খুশি গ্রেফতার করছে এবং আটক রাখছে। এর কোনো বাছ-বিছার নেই।
এই আইনে গ্রেফতার করে আটক রাখা হয়েছে নোয়াখালীর রামগঞ্জ থানার খিলপাড়া গ্রামের আবুল কাসেম চৌধুরীকে। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় অনেক খুনের অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। সরকারি ভাষ্য হচ্ছে–ঐ আইনে আটক করা না হলে কাসেম চৌধুরীকে খুনের আসামী হতে হয়। তাকে বাঁচাবার জন্যে সরকার তাকে নিরাপত্তাবন্দি করেছিল। অথচ কাসেম চৌধুরীর বক্তব্য ভিন্নরূপ।
ঐ কালো আইনে আটক রাখা হয়েছে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী ও তোফাজ্জল হোসেন পাটোয়ারীকে। একেবারেই তুচ্ছ ঘটনার জন্যেই তাদের আটক করা হয়েছে। পাড়া প্রতিবেশীর বিবাদ এবং থানার সাথে ঝগড়াই এই আটকের কারণ। ছোট ভাই তোফাজ্জল তখন ছাত্র। তাকে দেখতাম মুক্তির জন্যে প্রতিদিন সরকারের কাছে চিঠি লিখত। সে দরখাস্তে লেখা হতো পাকিস্তান আন্দোলনে তাদের ভূমিকার কথা। আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে সিলেটের গণভোটে অংশগ্রহণ। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় সিলেট ভারত না পাকিস্তানের অংশ হবে, এ প্রশ্নে গণভোট হয়। গণভোটে সিদ্ধান্ত হয় সিলেট পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে।
অদ্ভুত বিশেষ ক্ষমতা আইনে তিনজন ব্যক্তিকে আটক করে আনা হয়েছিল কুমিল্লা থেকে। এদের নাম ফজর আলী, অম্বর আলী ও সেকেন্দার আলী। তখন কুমিল্লা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন আইএ খান। ভারতের প্রথম পাকিস্তান হাইকমিশনার ইসমাইল খানের ছেলে। অপর এক বিখ্যাত আমলা মাদানীর ভাই। ঐ তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা আইএ খানের আর্দালিকে প্রহার করেছিল। এ অভিযোগে তিন ব্যক্তিকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার করা হলো। কুমিল্লার পুলিশ লিখে পাঠান, এই তিন ব্যক্তি জেলের বাইরে থাকলে পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। সুতরাং তকালীন স্বরাষ্ট্র দফতর সবকিছু অনুধাবন করে নির্দেশ দিলেন, এদের অনির্দিষ্টকালের জন্যে কারাগারে আটক রাখা হোক। এ হচ্ছে সেকালের পাকিস্তান ও পাকিস্তানের শাসকদের চিত্র।