এ প্রশ্ন উঠেছিল ভারত বিভাগ সম্পর্কিত আলোচনায়। আলোচনা হচ্ছিল ভারতের শেষ ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ও মোহাম্মদ আলী জিন্নার মধ্যে। তখন ভারত বিভাগের সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। প্রশ্ন উঠেছে পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাগ নিয়ে। জিন্নাহ প্রথম থেকেই বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের বিরোধিতা করেন।
লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন জিন্নাকে বলেন যে, আপনি নিশ্চয়ই সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা চান। সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিরাপত্তার জন্যই আপনি পাকিস্তান চেয়েছেন। যে পরিপ্রেক্ষিতে আশা করা যায় যে, আপনি নিশ্চয়ই হিন্দু শিখ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে অসম্মত হবেন না। কংগ্রেস ও শিখ সম্প্রদায় বাংলা ও পাঞ্জাবের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা চেয়েছে। তাদের প্রস্তাব বাংলা ও পাঞ্জাবের ভারত সংলগ্ন সংখ্যালঘু এলাকা ভারতের সাথে যুক্ত থোক অর্থাৎ পাঞ্জাব ও বাংলাকে ভাগ করা হোক।
মি. জিন্নাহ এ প্রস্তাবে রাজি হলেন না। তিনি বললেন, বাংলার একজন হিন্দু বা মুসলমান প্রথমে বাঙালি, পরে হিন্দু বা মুসলমান। পাঞ্জাবের একজন শিখ, মুসলমান বা হিন্দু প্রথমে পাঞ্জাবি, পরে হিন্দু, মুসলিম বা শিখ। সুতরাং সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে বাংলা বা পাঞ্জাবকে ভাগ করা যায় না। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন বললেন, মি. জিন্নাহ, আপনার কথা মেনে নিতে হলে ভারতও ভাগ করা যায় না। কারণ ভারতের নাগরিকেরা প্রথমে ভারতীয়, পরে হিন্দু, মুসলমান বা শিখ। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের এই কথার পর জিন্নাহ তেমন কোনো জবাব দেননি এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের প্রস্তাব মেনে নিতে হয়।
এছাড়া লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের সাথে আলোচনায় বিভক্ত ভারতের ভারত ও পাকিস্তান অংশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছিলেন কংগ্রেস নেতা আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেছিলেন, ভারতবর্ষ হিন্দু ও মুসলমানের ভিত্তিতে ভাগ হচ্ছে। অথচ পাকিস্তানে হিন্দুরা থাকছে, ভারতেও থাকছে মুসলমানেরা। তাদের নিরাপত্তা কী হবে? এ প্রশ্নের একটি অদ্ভুত জবাব দিয়েছিলেন লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন। তিনি বলেছিলেন, এই দুই দেশের সংখ্যালঘু একে অপরের জামানত হিসাবে বসবাস করবে। ভারতবর্ষের মুসলমানদের ওপর অত্যাচার হলে, অত্যাচার হবে পাকিস্তানি হিন্দুদের ওপর। আবার পাকিস্তানি হিন্দুদের ওপর অত্যাচার হলে, অত্যাচার হবে ভারতীয় মুসলমানদের ওপর। মাওলানা আজাদ এ মন্তব্য শুনে বলেছিলেন–এ উক্তি বর্বরের। বর্বরের এ সিদ্ধান্তের সাথে আমি আদৌ একমত নই। এর পরে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ আর ভারত বিভাগ সংক্রান্ত আলোচনায় যোগ দেননি।
তবে জিন্নাহর জন্যে শুধু সম্প্রদায়গত সমস্যা না, ভিন্ন সমস্যা ছিল পাকিস্তানে। মুসলিম লীগ কংগ্রেসের মতো সংগঠিত ছিল না। মুসলিম লীগের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ঐতিহ্য ছিল না। এছাড়া উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কংগ্রেস ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পূর্বে নির্বাচনের ও সীমান্ত প্রদেশে সীমান্ত গান্ধী আব্দুল গাফফার খানের নেতৃতে কংগ্রেস জিতেছিল। সিন্ধু এবং পাঞ্জাবেও মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল না। সুতরাং পাকিস্তান অর্জনে মুসলিম লীগ নেতৃত্ব দিলেও সমগ্র পাকিস্তানে মুসলিম লীগের নেতৃত্ব ছিল না। মি. জিন্নাহ বুঝেছিলেন, সাম্প্রদায়িক শ্লোগান দিয়ে দেশ শাসন সম্ভব নয়। তাই তিনি লোক দেখানো চাল দিলেন। পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম সভাপতি হলেন তপশীলি সম্প্রদায়ের নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল।
১৯৫০ সালের হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার সময় তিনি ঢাকা থেকে ভারতে পালিয়ে যান। উল্লেখ্য, তফশীল ফেডারেশন ভিআর অম্বেদকর ও যোগেন্দ্র নাথ মণ্ডলের নেতৃত্বে পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিল।
কিন্তু জিন্নাহ সাহেবের কোনো কৌশলই কাজে এল না। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান হিসেবে শক্তিশালী না হওয়ায় আমলা এবং সামরিক বাহিনী সক্রিয় এবং শক্তিশালী হয়ে উঠল। বিশেষ করে সামরিক বাহিনীতে এবং আমলাদের সঙ্গে পাঞ্জাবিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় পাঞ্জাবিরা পাকিস্তানে শক্তিশালী হয়ে উঠল।
বিরোধ দেখা দিল করাচি নিয়ে। অবিভক্ত ভারতে করাচি ছিল সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী। করাচি পাকিস্তানের রাজধানী হওয়ায় সিন্ধুর রাজধানী স্থানান্তরিত হলো হায়দারাবাদে। সিন্ধু নেতারা এ সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন না। ইতোমধ্যে জিন্নাহ সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁকে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য পাঠান হলো কোয়েটার জিয়ারতে। সিন্ধুর নেতৃবৃন্দ সেখানে জিন্না সাহেবের সাথে দেখা করে বললেন, তারা করাচিতে সিন্ধুর রাজধানী চান। এই প্রতিনিধি দলের সাথে গভর্নর জেনালের জিন্নাহর কথা কাটাকাটি হলো। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠল।
আমি জেলে গিয়েছিলাম ১৯৪৮ সালের ২১ আগস্ট। তখন পূর্ববঙ্গে কোনো সংবাদপত্র ছিল না। কলকাতা থেকে ইত্তেহাদ, স্টেটসম্যান, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, আনন্দবাজার, যুগান্তর আসত। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জেলখানায় হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডর একটি সংখ্যা হাতে এল। সে কাগজে একটি খবরে বলা হয়েছে–পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মরতে বসেছেন বা মারা গেছেন জিয়ারতে। তাঁকে দেখার কেউ নেই। তার চিকিৎসা হচ্ছে না। এরপর ১১ সেপ্টেম্বর এক সময় দেখলাম জেলখানার ভবনে ওড়ানো পাকিস্তানি জাতীয় পতাকা নামানো হচ্ছে। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করা হয়েছে। জিন্নাহ সাহেব মারা গেছেন। কোথায় মারা গেলেন জিন্নাহ সাহেব–জিয়ারতে? জিয়ারত থেকে বিমানে করাচি পৌঁছাবার সময় বিমানে? না করাচিতে তার বাসভবনে? এ প্রশ্নের জবাব আজো মেলেনি।