থানায় যাবার সাথে সাথে ওসি সাহেব বললেন, আপনার বাসায় যেতে হবে। আমি বললাম, কেন? আর বাসায় যেতে হলে আমি হেঁটে যেতে পারব না, রিকশায় যেতে হবে। আমার বাসার চারপাশে জল। আমি আর পিনাকী বোস কাকীমার বাসা পাহারা দিতাম। আমাদের এক কাজের মেয়ে ছিল। আর ছিল তার স্বামী। সেদিন পিনাকী বরিশালে ছিল না। কাজের মেয়েটির স্বামীও বাড়ি গিয়েছিল। ইতোমধ্যে কলেরা হয়ে কাজের মেয়েটি মারা গেল। আমি তখন একেবারে একা। কোনোমতে সকালের দিকে ওর সকারের ব্যবস্থা করে বাইরে বেরিয়েছি। এমন সময় পুলিশ এল বাসায়। আমাকে সাথে করে নিয়ে আমার বাসায় পৌঁছাল সন্ধ্যার পর।
এবার শুরু হলো তল্লাশি। আমার বাসায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পত্র-পত্রিকা ছিল। প্রতিটি পত্রিকা পেয়েই পুলিশ চমকে যাচ্ছিল। হঠাৎ এক পুলিশ বলল–একটি রিভলবার পাওয়া গেছে। রিভলবারের কথা শুনে আমিও চমকে উঠলাম। দেখলাম একটি খেলনা রিভলবার। যাদের ফেলে যাওয়া বাড়িতে আমি ছিলাম এ খেলনা রিভলবার তাদের বাচ্চাদের। কিন্তু পুলিশকে কিছু বিশ্বাস করানো যায় না।
তারা বলছিল অনুশীলন সমিতির কথা। বলছিল, আপনার রাজনীতির হাতেখড়ি অনুশীলন সমিতির কাছে। অনুশীলন সমিতির নেতারা এই খেলনা রিভলবার দিয়েই ডাকাতি করত। সুতরাং এই রিভলবার আপনার নামেই থানায় জমা হবে।
থানায় ফিরতে ফিরতে রাত ১০টা হয়ে গেল। ওসি সাহেব খুব ভদ্র ব্যবহার করলেন। কাগজে লিখলেন নির্মল সেনের বাড়ি তল্লাশি করা হয়েছে এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে…। এ কথা লিখতেই আমি বললাম, লিখুন, তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বিশেষ ক্ষমতা আইনের সাতের তিন ধারায়। ওসি সাহেব বললেন, না আপনাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৮ ধারায়।
আমি একদম চুপসে গেলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ১৮ ধারার অর্থ হচ্ছে বিনা বিচারে আটক। বিনা বিচারে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্দি রাখা। আমি কোনো আদালতে যেতে পারব না। মামলা করতে পারব না। সরকারের খেয়াল-খুশি অনুযায়ী যতদিন ইচ্ছে আমাকে জেলে রাখা যাবে। মাত্র ৮ দিন পর আমার বিএসসি পরীক্ষা। ভেবে পাচ্ছিলাম না কী করব।
তবে থানা কর্তৃপক্ষ খুবই ভালো ব্যবহার করেছিলেন আমার সাথে। ওসি সাহেব তাঁর বাসা থেকে বিছানা দিয়েছিলেন। খাবার দিয়েছিলেন। পরের দিন ভোরে এসে বললেন–আপনাকে তাড়াতাড়ি জেলে পাঠাতে হবে। আমি গোয়েন্দা বিভাগের লোকদের ডাকছি। আপনার সাথে ওরা কথা বলতে পারে। ওদের হেফাজতে আপনাকে দেব না, তাহলে ওরা মারপিট করবে। আপনার আগে কমিউনিস্ট পার্টির অনেক নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের ওপর বেদম অত্যাচার করা হয়েছে। আমি আপনাকে আগেই জেলে পাঠিয়ে দেব।
ওসি সাহেবের কথামতো গোয়েন্দা বিভাগ থেকে একজন লোক এল। আমার সাথে ঘন্টা দুয়েক কথাবার্তা হলো এবং কথাবার্তার শেষে আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো জেলখানায়। সে হচ্ছে আমার জেলজীবনের শুরু। দু’দিন বাদে গ্রাম থেকে কাকা এলেন আমার সাথে দেখা করতে। তিনি বাড়িতে খবর পেয়েছেন পুলিশের কাছ থেকে। পুলিশের বড় কর্মকর্তারা বাড়িতে চিঠি লিখেছেন, আপনাদের ছেলেকে বরিশাল থেকে নিয়ে যান। নইলে গ্রেফতার হতে পারে যে কোনোদিন। সে চিঠি বাড়ি পৌঁছেছিল আমি গ্রেফতার হয়ে যাবার পর।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে তখন এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ শুধুমাত্র ইসলামের কথা বলে পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিলেন। পাকিস্তানের কোনো রূপরেখা তাদের সামনে ছিল না। সমস্যা দেখা দিল পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে। পাকিস্তান সৃষ্টি হলো মুসলমানদের স্বতন্ত্র বাসভূমির দাবিতে। বলা হলো–হিন্দু, মুসলমান দুই জাতি। তাদের সংস্কৃতি এবং কৃষ্টি আলাদা। তাদের একই সাথে বসবাস করা সম্ভব নয়। তাই এই দুই জাতির জন্য দুটি রাষ্ট্রের প্রয়োজন। কিন্তু পাকিস্তান প্রস্তাবে দুই রাষ্ট্রের হিন্দু ও মুসলমান জনগোষ্ঠী বিনিময়ের কোনো প্রস্তাব ছিল না। পাকিস্তান প্রস্তাব মতে, ভারত ভেঙে দুটি রাষ্ট্র হলেও উভয় রাষ্ট্রে হিন্দু এবং মুসলমান উভয় জাতিই থাকবে। লোক বিনিময় হবে না। পাকিস্তান প্রস্তাবের এটাই ছিল সবচেয়ে দুর্বল দিক। মুসলমানদের জন্যে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র চাই। মুসলমানদের জন্যে ভারত ভেঙে পাকিস্তান করতে হবে। অথচ খণ্ডিত ভারতবর্ষের ভারত অংশে ৬ কোটি মুসলমানকে হিন্দুদের সাথেই বসবাস করতে হবে। আবার হিন্দুদের সাথে এক সাথে বসবাস করা যাবে না–এই চুক্তিতে মুসলমানদের জন্যে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাকিস্তান হলেও পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গে দেড় কোটি হিন্দু থেকে গেল।
দেশ বিভাগের পূর্বে মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র কাছে এ প্রশ্নটি তুলেছিলেন ভারতীয় মুসলমানরা। তারা বলেছিলেন, হিন্দুদের সাথে থাকা যাবে না, এ চুক্তিতে আমরা পাকিস্তান আন্দোলন করেছি। অথচ আমাদের ভারতেই থেকে যেতে হচ্ছে। তাহলে আমাদের নিরাপত্তা কোথায়? হিন্দুরা আমাদের বিশ্বাস করবে কেন? মুসলিম লীগ সভাপতি জিন্নাহ তখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হয়েছেন। এ কথার জবাব তিনি ভারতের মাটিতে দিলেন না। পাকিস্তান পৌঁছে জিন্নাহ বিমানবন্দরে বললেন, রাজনৈতিকভাবে কোনো মুসলমান এখন আর মুসলমান নয়, কোনো হিন্দু আর কোনো হিন্দু নয়, সকলেই পাকিস্তানি। অর্থাৎ ভারতীয় মুসলমানদের ভারতীয় নাগরিক হিসাবেই থাকতে হবে। পাকিস্তান প্রস্তাবকে তিনি জোড়াতালি দিয়ে বাঁচাতে চাইলেন। প্রকৃতপক্ষে এভাবে জোড়াতালি দিয়ে পাকিস্তান প্রস্তাবকে বারবার বাঁচিয়ে ভারতকে ভাগ করা হয়েছিল ১৯৪৭ সালে।