২১ এপ্রিল ইকবাল দিবস। আমাদের ছাত্র প্রতিষ্ঠান পাকিস্তান ছাত্র এসোসিয়েশন (পিএসএ) ইকবাল দিবস পালনের অনুমতি চেয়েছিল। অনুমতি দেয়া হলো না। উপরন্তু ইকবাল দিবস পালনের পোস্টারটিও বাজেয়াপ্ত করা হলো।
উল্লেখ্য, পাকিস্তান সৃষ্টির পর আমরা ছাত্র কংগ্রেস নামে একটি প্রতিষ্ঠান কাগজে-কলমে বাঁচিয়ে রাখলেও, মূল ছাত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি পাকিস্তান ছাত্র এসোসিয়েশন নামে। আরএসপি এ সিদ্ধান্ত নেয় ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে ময়মনসিংহ শহরে। এ সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক নির্বাচিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মৃণাল দত্ত ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র রুহুল আমিন কায়সার।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের শেষে কাকীমাকে দিতে যাই কলকাতায়। টেলিগ্রাম এল তাড়াতাড়ি চলে এসো। মা, ভাইবোন সকলে কলকাতা চলে গেছে। সকলকে বোঝাতে হলো, বিএসসি পাস করেই চলে আসব। বরিশালে ফিরে দেখি সব গোলমাল হয়ে গেছে। বোমার মামলার পর জুন মাসে আমাদের এক পোস্টার নিয়ে মামলা হলো। পোস্টারে লেখা হয়েছিল খাদ্য সমস্যা নিয়ে। আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল–আবারও কি পঞ্চাশ সালের মতো দুর্ভিক্ষ আসছে! এবার গ্রেফতার হয়ে গেলেন দলের নেতা অনিল দাশ চৌধুরী, মোজাম্মেল হক, আব্দুল খালেক খান ও ছাত্রনেতা নারায়ণ দাশ শর্মা। নারায়ণ আমার সাথে বিএসসি পরীক্ষার্থী।
রাজনীতিকদের কাছে বরিশাল তখন এক বিপন্ন শহর। হাঁটতে গেলে লোক পিছু লাগে। উকিল-মোক্তার মামলা নিতে চায় না। কারো কাছে গেলে ভয় পায়। আমাদের পক্ষে দেন দরবার করার লোকও বিরল। হিন্দুদের মনে আশঙ্কা। জড়িয়ে পড়ে বিপদ ডেকে আনব নাকি।
আমার একমাত্র কাজ আইবি অফিসে যাওয়া। থানায় যাওয়া। আদালতে জামিনের জন্য চেষ্টা করা। আমার সুবিধে হচ্ছে দেশভাগের আগে আমার কাকা বরিশাল সদর থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার ছিলেন। আমি সকলের চেনা।
কিন্তু তদ্বিরে তেমন কাজ হলো না। বোমা মামলায় জামিন পাওয়া গেলো। পোস্টারের মামলায় জামিন মিলল না। ইতোমধ্যে এগিয়ে এসেছে নারায়ণের পরীক্ষা। পরীক্ষার আগে তার জামিন প্রয়োজন। ২৮ আগস্ট আমারও পরীক্ষা। নারায়ণ জামিনে মুক্তি পেল ১৮ আগস্ট। আমাকে গ্রেফতার করা হলো ২০ আগস্ট। মনে হলো এবার পরীক্ষা আর দেয়া হবে না। গ্রেফতার হয়ে বরিশালে রাজনীতির এক পর্ব শেষ হলো।
তবে পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছিলেন জেল কর্তৃপক্ষ। বরিশাল জেলখানা থেকে জনাদশেক পুলিশ আমার হাতে হাতকড়া দিয়ে মিছিল করে হেঁটে যেত বিএম কলেজে। রাস্তায় লোকের ভিড় হতো। পরীক্ষার হলে যেতাম। পড়ার বই ছিল না। তবুও পরীক্ষার নাম করে হলে যেতাম। বন্ধুদের চিঠি লিখতাম। দলের খবর আদান-প্রদান করতাম। দূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমার প্রিয় শিক্ষকেরা দেখতেন। সকলেই বিষণ্ণ। কারণ কারো কিছু করার নেই বা ছিল না। এমনি করে পরীক্ষার ভান করতে করতে জেলে ফিরে দেখি নারায়ণ আবার গ্রেফতার হয়ে এসেছে। কারণ তার লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে। বিজ্ঞানের ছাত্র। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা বাকি। তাই তাকে আর বাইরে রাখা ঠিক নয়। আমরা বাইরে থাকলে পাকিস্তান কি টিকবে!
এবার দুজনেই প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা দেবার জন্য কলেজে গেলাম। আজ দীর্ঘদিন পরে সেকালের শিক্ষক আর ল্যাবরেটরির পিওনদের জন্য দুঃখ বেদনায় মন ভারাক্রান্ত হয়। ওরা প্রত্যেকে প্রাকটিক্যাল পরীক্ষায় আমাকে সাহায্য করেছিল সব দিক থেকে। কেউ জানত না আমি পরীক্ষা দিচ্ছি না। প্রতিদিন ভান করছি পরীক্ষার নামে।
আমি জেলে যাব এ কথা আমি আদৌ ভাবিনি। ভেবেছিলাম সবাই গ্রেফতার হলে আমি বেঁচে যাব। দেশ ভাগের আগে আমার কাকা বরিশালের পুলিশ বিভাগে ছিলেন। পারিবারিক সূত্রে পুলিশ বিভাগের বড় বড় কর্মকর্তাদের সাথে আমাদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তখন আমার একমাত্র কাজ ছিল সকল দলের বন্দিদের জন্য তদবির করা। প্রতিদিন আমাকে থানায় যেতে হতো। আইবি অফিসে যেতে হতো। আদালতে যেতে হতো। তখন আমি বিএম কলেজের বিএসসি শেষ বর্ষের ছাত্র। আমাদের পার্টি অফিস সদর রোডের আর্ট ভিলার দোতলায়। নিচতলায় বাড়ির মালিক অনিল ঘোষ। অনিল দা আমাদের দলের সমর্থক ছিলেন। অনিল দার কাকা প্রবীণ বিপ্লবী দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ। অনিলদার ওখানে বসতাম। এক কাপ চা খেতাম। অনিলদা বলতেন–এবার তুমি চলে যাও। তোমার পাহারাদার এসে গেছে। আমি উঠবার সাথে সাথে ৪ বার আমার পিছু নিত। প্রায় সারা দিন এ চারজনের পাহারায় আমাকে ঘুরতে হতো। মাঝে মাঝে কেমন যেন মনে। হতো। আমি হাফ প্যান্ট ও হাফ শার্ট পরা এক তরুণ। আমার পেছনে চার জন লোক প্রকাশ্য দিবালোকে ঘুরছে। আমাকে পাহারা না দিলে নাকি পাকিস্তান টিকবে না। সেই পাহারা দেবার পালা শেষ হলে ২০ আগস্ট। আমি বিকালে আর্টভিলার কাছে এসে দাঁড়িয়েছি। সাদা পোশাকের দুই ভভদ্রলোক এসে বললেন-আমরা পুলিশের লোক। আপনাকে থানায় ওসি সাহেব ডেকেছেন। আমি বললাম, আমার যাবার সময় নেই। আমার সাথে ছিল আমার বন্ধু নারায়ণ দাশ শর্মা। নারায়ণ জামিনে মুক্তি পেয়েছে ১৮ আগস্ট। নারায়ণ বলল, তুই থানায় গিয়ে দেখে আয় তোকে কেন ডেকেছে। আমি বাসায় যাচ্ছি।