সভা শেষে বাদলদের বাড়ি গেলাম। বাদলের মা বললেন, তুমি বসো। তুমি দুপুরে এখানে খাবে, ঘুমাবে। বিকালে তোমাকে নৌকা করে দেব। তুমি যেখানে খুশি যাবে। আমি বললাম, আমি খেয়ে এসেছি। বাদলের মা হেসে ফেললেন। বললেন, তুমি লক্ষ করনি যে যাবার সময় তোমাকে আমি দেখেছি। বুঝেছিলাম তুমি কিছুই খাওনি ভোর থেকে। আমার রান্না হয়ে গেছে। তুমি খেয়ে যাবে।
বাদলের মা’র কথা অসত্য ছিল না। আগের দিন বরিশাল থেকে বানারীপাড়ায় পৌঁছেছিলাম। থাকার জায়গা ছিল না। উঠেছিলাম নরত্তোমপুরের রামকৃষ্ণ মিশনে। মিশনে বড় বড় পাথরের বাটি, জল, নিরামিশ আর বড় বড় লাল চালের ভাত। রাতে তেমন খাওয়া হয়নি। ভোরে সেখানে খাবার প্রত্যাশাও ছিল না। ভোরে রওনা হয়ে এসেছি স্বরূপকাঠি।
সেকালে ভাটা ও জোয়ারের উপর নির্ভর করে নৌকা চলাচল করত। বানারীপাড়া থেকে ভাটিতে স্বরূপকাঠি জলবাড়ি, কাউখালী হয়ে পিরোজপুর যাওয়া যেত। জোয়ারের সময় আবার ফেরা যেত একই পথে নৌকায়। পয়সা অনেক কম লাগত। সেদিনও সূর্য পশ্চিমে হেলে যেতে থাকলে বাদলের বাড়ি স্বরূপকাঠি থেকে হুলারহাট যাবার নৌকায় উঠেছিলাম। নেমেছিলাম সমুদয়কাঠি। গন্তব্যস্থান উপেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ি। উপেন্দ্রনাথ দত্ত পিরোজপুরের হিন্দু স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তাঁর ছেলে সরোজ আমাদের সাথে রাজনীতি করত। সে অনেক কাল আগের কথা। অনেক ঘটনার এক ঘটনা। কোনোদিন মনে করিনি বাদল আর বাদলের মা’কে। যিনি বলেছিলেন, তুমি কার ছেলে জানি না। আমার বাড়ি থেকে না খেয়ে যেতে পারবে না। তুমি খেয়ে ঘুমাও। বিকালে আমি নৌকা ঠিক করে দেব।
তবে টেস্ট পরীক্ষা না দিলেও পরীক্ষার জন্য এলাউ হতে আমার তেমন কষ্ট হয়নি। কলেজের অধ্যাপকরা আমাকে বড্ড ভালবাসতেন। বিশেষ করে ভালোবাসতেন পদার্থবিদ্যার শিক্ষক বিমলাপ্রসন্ন রায়। তিনি কলেজের সব কিছু নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। লেখাপড়া থেকে খেলাধুলা সবই তাঁর নেতৃত্বে হতো। শিক্ষক হিসেবে তিনি তেমন নাম করতে পারেননি। কিন্তু নাম করেছিলেন পরোপকারে। বিমলাপ্রসন্ন রায় সব ছাত্রদের বন্ধু।
টেস্ট পরীক্ষার পর কলেজে ঢোকামাত্র তিনি চিৎকার করে উঠলেন। বললেন, কোথায় ছিলে? পরীক্ষা দাওনি কেন? আমি বললাম, আমি এবার পরীক্ষা দেব না। আমার প্রস্তুতি নেই, টাকাও নেই। বিমলা বাবু বললেন, কোনো চিন্তা নেই, সবই হবে। তুমি টেস্টে অ্যালাউ হবে। তোমার টাকাও জোগাড় করা হবে। তিনি আমাকে সঙ্গে করে অধ্যক্ষ সুরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের কাছে নিয়ে গেলেন। আমি পরীক্ষায় অ্যালাউ হলাম। আমার ৫ মাসের মাইনে মাফ করা হলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিক অবস্থায় পরীক্ষা দিতে পারলাম না।
১৯৪৮ সালের ২৮ আগস্ট আমার বিএসসি পরীক্ষা শুরু। গ্রেফতার হয়ে গেলাম ২০ আগস্ট। অদ্ভুত এক স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হলো। কোথায় মানুষ উল্লাস করবে, উৎসব করবে! সেই উৎসব এল খণ্ডিত রূপে। পাকিস্তানে হিন্দু, শিখ সম্প্রদায় এবং ভারতে মুসলমানরা ভয়ে ভয়ে থাকল। পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ ব্যতীত কংগ্রেসসহ সকল রাজনৈতিক দলের মনে হলো কখন জেলে যেতে হবে। বিশেষ করে শঙ্কিত হলো কমিউনিস্ট পার্টি ও আরএসপি। এরা মার্কসবাদে বিশ্বাস করে। এরা সমাজতন্ত্রী। নাস্তিক। পাকিস্তান ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র। পাকিস্তানে কোরান-সুন্নার অনুসরণে সংবিধান হবে। এ রাষ্ট্রে এই বামপন্থীদের স্থান কোথায়!
বিশেষ করে ভয় দেখা দিল আরএসপি’র। কমিউনিস্ট পার্টি ভারত বিভাগ সমর্থন করেছে। কমিউনিস্ট পার্টির জ্যোতি বসু ও রতন লাল ব্রাহ্মণ, রূপনারায়ণ রায় আইনসভায় বাংলা ভাগের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। দেশ বিভাগের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু আরএসপি আন্দোলন করেছে সার্বভৌম বাংলার জন্য।
এছাড়া বরিশালে আছে আর এক বিপদ। বরিশালের মুসলিম লীগে নাজিমুদ্দিন গ্রুপের মুসলিম ছাত্রলীগের প্রভাব বেশি। তাদের সাথে এক হয়ে আরএসপি’র ছাত্র কংগ্রেস গান্ধী নিহত হবার পর বরিশালে মিছিল ও আন্দোলন করেছে। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে নাজিমুদ্দিন গ্রুপ মুসলিম ছাত্রলীগের সাথে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে হরতাল করেছে। ক্ষমতাসীন মহলে এ নিয়ে উমা আছে। আছে উদ্বেগ। ইতোমধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছে কলকাতায়। সাবেক সম্পাদক পিসি যোশীকে সরে যেতে হয়েছে। সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন বিটি রনদিতে। কমিউনিস্ট পার্টি জঙ্গি লাইন নিয়েছে। ঘোষণা করেছে, ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হায়, লাখ ইনসান ভুখা হ্যায়’। সুতরাং এবার আন্দোলন।
কংগ্রেসের পর কমিউনিস্ট পার্টিও আন্দোলনে নেমেছে। দেয়ালে পোস্টার পড়েছে। গ্রেফতার হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা। তাদের ওপর চরম নির্যাতন নেমে আসছে। একদিনে বরিশাল সদর রোডে আমাদের পার্টি অফিসের কাছাকাছি গিয়ে শুনলাম, পুলিশ অফিস ঘেরাও করেছে। গ্রেফতার হয়েছে তিনজন কর্মী। পার্টি অফিসে নাকি বোমা পাওয়া গিয়েছে। একেবারে তাজা বোমা।
এ বোমা রেখেছিলেন আমাদের মুসলিম ছাত্রলীগের এক বন্ধু পুলিশের সহযোগিতায়। এখানেও শেষ রক্ষা হলো না। কমিউনিস্ট পার্টি মে দিবস পালনের অনুমতি চাইল। জেলা কর্তৃপক্ষ রাজি হলো না। বলা হলো রাশিয়ার কোনো দিবস পাকিস্তানে পালিত হবে না। অন্ধ কমিউনিস্ট বিদ্বেষ তাদের বিচার-বুদ্ধিকেও লুপ্ত করেছিল।