পূজার সময় আমার সাংবাদিক ও অধ্যাপক কাকা ড. ধীরেন্দ্রনাথ সেন বাড়ি এলেন। সেটাই তাঁর শেষবারের মতো বাড়ি আসা। তিনি একটা অদ্ভুত কথা বললেন। তিনি বললেন, তোমরা কেউ দেশ ছেড়ে চলে যেও না। তোমরা দেশ ছেড়ে গেলে এসকল গ্রামে অবাঙালিদের পুনর্বাসিত করা হবে। পাকিস্তান হবে দুই অর্থনীতির দেশ। অর্থনৈতিক কারণেই পাকিস্তান টিকবে না। টিকতে পারে না।
সেই আমার কাকার সাথে শেষ দেখা। কাকা বাড়ি থেকে চলে যাবার পর আমাদের বাড়িতে পুলিশের হামলা হলো। হঠাৎ পুলিশ এসে দালানের সিঁড়ির নিচ থেকে একটি অকেজো বন্দুক আবিষ্কার করল। ঘন্টার পর ঘন্টা মেয়েদের আটকে রাখল। সারা বাড়ি জুড়ে এক তোগলকি কাণ্ড। পুলিশের নেতৃত্ব দিলেন বর্ডার মিলিশিয়ার নর্টর জোন্স। আমার সেই কংগ্রেসি কাকাকে গ্রেফতার করা হলো। আমাদের বাড়িতে হামলা চালাবার আগে বেছে বেছে ১৬ জন তফশিলি নেতাকে গ্রেফতার করা হলো। গোপালগঞ্জে তখনও হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তফশিলি নেতারা খুবই প্রভাবশালী। আমাদের বাড়িতে হামলার প্রতিক্রিয়া হলো তীব্র। গ্রামের পর গ্রাম শূন্য হতে থাকল। শতকরা ৯৫ জন মধ্যবিত্ত হিন্দু দেশ ছেড়ে চলে গেল। আমি তখন বরিশালে। চতুর্থ বর্ষ বিএসসির ছাত্র। বিএসসি পরীক্ষা এগিয়ে আসছে। পড়াশোনার খোঁজ নেই। অনার্স পড়া ছেড়েছি বছরখানেক আগে। রাজনীতি করে অনার্স পড়া হয় না। দল থেকে বলা হয়েছে অনার্স পড়া চলবে না। নিয়মিত বিএসসি পরীক্ষা দেবে কিনা তাও ভেবে দেখতে হবে। তোমরা বিএসসি পরীক্ষা দিয়ে চলে গেলে নেতৃত্বের শূন্যতা দেখা দেবে। এ পরিস্থিতিতে বিএসসি টেস্ট পরীক্ষা এগিয়ে এল। আমি তখন বরিশাল শহরের কালিবাড়ি রোড বাণীপীঠ স্কুলের একটি কক্ষে থাকি। সে স্কুলটি এখন নেই। বরিশাল বিএম স্কুলের পশ্চিমে সেই এলাকায় এখন পরিবার পরিকল্পনার বিরাট দালান। ১৯৫০ সালের দাঙ্গার পর বাণীপীঠ স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্নেহাংশু সেনগুপ্তকে গ্রেফতার করা হয়। স্কুলটি উঠে যায়। সেই স্কুলের জমিতে পরবর্তীকালে ধান চাষ করতে দেখেছি। পরে উঠেছে পরিবার পরিকল্পনার দালান।
সেই বাণীপীঠ স্কুলের কক্ষে মোমবাতি জ্বালিয়ে পরীক্ষার পড়া পড়ছিলাম। পরের দিন টেস্ট পরীক্ষা। সন্ধ্যার পরে অনিলদা এলেন। অনিলদা অর্থাৎ দলের নেতা অনিল দাশ চৌধুরী এসে বললেন, তোমার কাল পরীক্ষা দেয়া হবে না। কলকাতা থেকে কৃষ্ণ সেন এসেছেন। বাড়ি খলিশাকোঠা। কৃষ্ণ সেন কৃষক ফ্রন্টে কাজ করছেন। আমাদের কৃষক ফ্রন্টে কিছু কাজ আছে গৌরনদীর মেদাকূলে। তোমাকে কৃষ্ণ সেনের সঙ্গে মোকূল যেতে হবে।
সুবোধ বালকের মতো ব্যাগে জামা কাপড় গোছালাম। মোমবাতি নেভালাম। ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বুঝলাম এবার বিএসসি পরীক্ষা দেয়া আমার হবে না। তখন জানতাম না, আর এক ঘটনা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
চারদিন পরে বরিশাল ফিরলাম। এসে দেখলাম আমার রুম খোলা। কাপড় জামা বই বিছানা কিছুই নেই। পার্টি অফিসে ছুটলাম। অনিলদা বললেন, তোমার সব কিছু নিয়ে গেছে পিনাকী বোস। তুমি পিনাকীর খুড়তুতো বোনদের গালি দিয়েছিলে। তুমি নাকি বলেছিলে এ বয়সের মেয়েদের ড্যাং ড্যাং করে রাস্তায় বের হওয়া ঠিক নয়। পার্টির কাজ থাকলে তাদের বাড়িতে খবর দেয়া হবে। পিনাকীর কাকীমা একথা শুনে ক্ষেপে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শাসন করতে হলে ঐ ছেলে যেন আমাদের বাড়িতে এসে শাসন করে। রাস্তায় আমাদের মেয়েদের শাসন করা যাবে না। তাই তোমার অনুপস্থিতিতে ওরা তালা খুলে সবকিছু নিয়ে গেছে। ঘটনাটি এমন দাঁড়াবে তা আমি কোনোদিন ভাবিনি। সেকালে রাজনীতির মেয়েদের নিয়ে অনেক কথা হতো। এ ব্যাপারে কমিউনিস্ট পার্টির দুর্নাম ছিল সবচেয়ে বেশি। ইতোমধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির অসংখ্য কমরেড নিজেরা নিজেরা বিয়ে করে ফেলেছেন। অনেকে কৌতুক করে কমিউনিস্ট পার্টির অফিসকে প্রজাপতির অফিস বলত। তাই পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়াচ্ছিল ভিন্নতর।
আমাদের দলে অনেক মেয়ে ছিল। আমরা আবার অনুশীলন সমিতির উত্তরাধিকার। অনুশীলন সমিতির অধিকাংশ নেতা অকৃতদার, সংযমী, উদার এবং আদর্শ চরিত্রের অধিকারী। তাই মেয়েদের রাজনীতি নিয়ে আমাদের অফিসেও আলোচনা হতো। একদিন ছাত্র বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিল আমাদের অফিসে এমন ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে তার ব্যবস্থা নিতে হবে। দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমাকে। তাই যা ঘটবার তাই ঘটেছে। পিনাকীর বোন শান্তি, তার কাকার মেয়ে সাধনা ও বাসনা প্রায় প্রতিদিন আমাদের অফিসে আসত। আমি তাদের একদিন ধমকে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, কাজ না থাকলে অফিসে না আসতে। যার পরিণতিতে পিনাকীদের বাসায় আমার যেতে হলো। তবে সেখানেও আমার বেশি দিন থাকা হয়নি। তারাও এদেশে থাকেনি। ১৯৪৮ সালের ২৯ মার্চ ওদের আমি পৌঁছে দিয়েছিলাম শিয়ালদহ। শিয়ালদহ স্টেশনে পিনাকীর কাকিমা বলেছিলেন আমি কলকাতায় বাড়ি করব। তোমার জন্য একটি কক্ষ থাকবে সেই বাড়িতে। যদি কোনোদিন ভারতে আস তাহলে আমার খোঁজ কোরো।
তারপর ৪৮ বছর কেটে গেছে। ১৯৭১ সাল থেকে ভারতে যাতায়াত করছি। কোনোদিনই কাকীমাকে খোঁজ করা হয়নি। খোঁজ করিনি সাধনা, বাসনা বা শান্তির। আর এতদিন নিশ্চিয়ই কাকিমা বেঁচে নেই। আর সবচেয়ে মর্মান্তিক হচ্ছে বেঁচে নেই আরএসপির এককালের একনিষ্ঠ কর্মী পিনাকী বোস। গৌরনদী থানার চাঁদসী বোস বাড়ির ছেলে পিনাকী বোস। আত্মীয় স্বজন সব চলে গেলেও পিনাকী বোস পাকিস্তান ছাড়েনি। তাকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে ‘৭১ সালে। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী পিনাকী বোসকে খুন করেছে। আমার কাকীমার কাছে যাবার যোগাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেছে। শুধু পিনাকী বোসের কাকীমা-বরিশালের চাঁদসীর সতীশ বোসের স্ত্রী নন, এমন অনেক মা-বোনের কথা আজ মনে পড়ে। ১৯৪৭ সালের জুন মাস। রাজনীতির কারণে গিয়েছিলাম বানারীপাড়া, স্বরূপকাঠি, কামারখালী, জলাবাড়ি ও সমুদয়কাঠি। স্বরূপকাঠিতে খালের পাড়ে এক ক্লাবঘরে সভা করছিলাম। সভায় বাদল দত্ত নামে একটি ছেলে এল। স্কুলের ছাত্র। বলল, মা আপনাকে ডেকেছে। আমি বললাম, তোমার মা। তিনি আমাকে দেখলেন কী করে? বাদল বলল, আপনি যখন খালপাড় দিয়ে আসছিলেন মা আপনাকে দেখেছেন।