- বইয়ের নামঃ আমার জবানবন্দি
- লেখকের নামঃ নির্মল সেন
- বিভাগসমূহঃ আত্মজীবনী
১. অনেকে আমাকে সাংবাদিক বলে চেনে
প্রকাশক : ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ
প্রথম ইত্যাদি সংস্করণ : ফেব্রুয়ারি ২০১২
উৎসর্গ
বাবা
সুরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত
মা
লাবণ্যপ্রভা সেনগুপ্ত
.
[আমার জবানবন্দী। এটি নির্মল সেনের আত্মজীবনী নয়। তবে তার লেখার মধ্যে আত্মজীবনীর একটি ছায়া পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবে পুরো পাকিস্তান আমলের রাজনৈতিক বাস্তবতার চিত্র এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতীয় উপমহাদেশের তথা বিশ্বরাজনীতির একটি চলমান চিত্র বা ঘটনাপুঞ্জি। একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের চোখে সেই সময়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। আমাদের মাঝে যে বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধ এসেছিল তার নানামাত্রিক ব্যাখ্যা এবং কঠোর কঠিন এক বাস্তবতার কথা নিজস্ব চিন্তায় তুলে ধরেছেন লেখক।
পাকিস্তান আমলের সামরিকতন্ত্র আর মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা তিনি যেভাবে দেখেছেন তা বোধকরি এভাবে এর আগে কেউ ব্যাখ্যা করার সাহস দেখাননি। সময় এবং ঘটনা তিনি যেভাবে অকাট্য যুক্তি, অকপট স্বীকারোক্তি এবং কঠিন বাস্তবতাকে একজন রাজনীতিকে চোখে ব্যাখ্যা করেছেন তা কেবল তার পক্ষেই সম্ভব। স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতাকে তিনি যেভবে সাহস করে তার কলমে তুলে ধরেছেন তা দ্বিতীয় কেউ পারেননি। তার এ লেখা এককথায় বিগত শতাব্দীর উপমহাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলন ও তার ইতিহাস এবং বাস্তবতার এক অখণ্ড দলিল; যেখানে প্রকাশ পেয়েছে জন্মভূমি বাংলাদেশের প্রতি আজন্ম দায়বদ্ধ থাকা একজন রাজনীতিকের তীব্র হাহাকার।]
.
মুখবন্ধ
প্রায় এক দশক ধরে আমি অসুস্থ। এখন আমি আমার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় থাকি। শুনতে পারি, বুঝতে পারি, কিন্তু লিখতে পারি না। চোখে দেখি না। আমার কথা আমার একান্ত কাছের স্বজনেরা ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না। এ অবস্থার মধ্যেও নানাজন তাগিদ দেয় কিছু একটা লিখবার। এ কাজে আমাকে এখন সহযোগিতা করে আমার ভাইয়ের ছেলে কংকন সেন ও আমার পড়শি স্থানীয় সাংবাদিক মিজানুর রহমান বুলু। অসুস্থ হওয়ার আগে ঢাকায় থাকতে এ কাজে সহযোগিতা করতে সাংবাদিক হোসেন শহীদ মজনু এবং প্রশান্ত অধিকারী।
আমার জবানবন্দি বই আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলাম ২০০০ সালে। তারও আগে বিভিন্ন ম্যাগাজিনে এই বইয়ের কিছু লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল সাংবাদিক দীপঙ্কর গৌতমের সহযোগিতায়। সর্বশেষ কাজটি যখন করছিলাম তখন আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। তাই কাজটি আর এগোয়নি। ফলে যেভাবে পাণ্ডুলিপিটি ছিল সেভাবেই তরফদার প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মাহবুব আলম বইটি প্রকাশ করে। সেখানে নানা ভুলত্রুটি ছিল। পরবর্তীতে আমার এক সময়ের সার্বক্ষণিক সহযোগী প্রশান্ত অধিকারীর সহযোগিতায় ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ-এর স্বত্তাধিকারী জহিরুল আবেদীন জুয়েল ও আদিত্য অন্তর বইটি প্রকাশের আগ্রহ দেখায়। তারা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছে বইটি নির্ভুলভাবে প্রকাশের। আমি তাদের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।
অনুসন্ধিৎসু পাঠক যদি বইটি পড়ে সেকালের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারেন এবং জানতে পারেন সে সময়ের ইতিহাস সে লক্ষ্যেই আমার এ প্রয়াস। এ লেখায় আমার অনেক রাজনৈতিক ও সাংবাদিক বন্ধুদের কথা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে উল্লেখ করেছি। অনেকে মনে করতে পারেন আমি তাদের সমালোচনা করেছি। আসলে তা নয়। এটা একান্তই আমার রাজনৈতিক চিন্তা ও অভিজ্ঞতাপ্রসূত মতামতের বহিপ্রকাশ। আশা করি এ নিয়ে আমার বন্ধুরা ভুল বুঝবেন না।
নির্মল সেন
দিঘীরপাড়, কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ
৩১ জানুয়ারি ২০১২
.
আজকে অনেকে আমাকে সাংবাদিক বলে চেনে। অথচ সাংবাদিক হবার কোনোই কথা ছিল না। ভবিষ্যতে কী হব সে নিয়ে এমন কোনো চিন্তা-ভাবনা শৈশবে ছিল না। বাবার এক খুড়তুতো ভাই ড. ধীরেন্দ্রনাথ সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ছিলেন, এক সময় হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড-এর সম্পাদক ছিলেন। সেই সূত্রে সাংবাদিকতা সম্পর্কে কৌতূহল ছিল স্কুল জীবন থেকে। কাকা বাড়ি এলে অসংখ্য পত্রিকা আসত। আমরাও কখনো কখনো হাতে লিখে কাগজ বের করতাম। তবে সে পটভূমিও আমাকে সাংবাদিক বানায়নি।
আমাদের গ্রামে মোটামুটি একটি ভালো লাইব্রেরি ছিল। যেখানে শীতিনেক ভালো ভালো বই ছিল। ঐ লাইব্রেরি চালাতে গিয়ে ব্রিটিশ শাসকদের কোপানলে পড়লেন আমার এক কাকা। আমার এক বোনকে পুলিশ ডেকে নিয়ে গেল রবীন্দ্রনাথের নটির পূজা ও রক্তকরবী পড়ার জন্যে। তখন থেকেই কিছুটা ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব জন্ম নেয়। তবে তাও খুব একটা উল্লেখযোগ্য কিছু নয়।
নানা কারণে আমার বাড়িতে থেকে পড়ালেখা হয়নি। পাঠশালায় পড়া শেষ করে আমি ভর্তি হয়েছিলাম গিমাডাঙ্গা টুঙ্গিপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। এই স্কুলটি আজকের টুঙ্গিপাড়া থানায় অবস্থিত। কাকারা সেখানে ডাক্তারি করতেন। ঐ স্কুলের শিক্ষকদের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানও লেখাপড়া করেছেন। টুঙ্গিপাড়ার পাটগাতিতে অবস্থান করার জন্যে শেখ সাহেবদের পরিবারের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তবে সে ছিল একান্তই পারিবারিক আত্মীয়তা, এর সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক ছিল না।