অনুষ্ঠান শেষে জার্মানির ক্রিস্টিনা আমাকে একটি সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য অনুরোধ করল। সময় নেই। অল্প কিছুক্ষণ কথা বলে দৌড়ে অপেক্ষমান গাড়িতে চড়ে বসতে হল। সোজা বিমানবন্দর। ম্যারিও ফিরল প্যারিসে আমার সঙ্গে। আঠার মত লেগে থেকে আমার কিছু কবিতা ফটোকপি করে নিল। ঘুমে আমার শরীর ভেঙে আসছিল। এই হচ্ছে প্রতি বিকেলে। প্যারিসের সময়ের সঙ্গে শরীর খাপ খাইতে চাইছে না। এখনও দেশের সময়ে শরীর নেতিয়ে পড়ছে, শরীর আড়মোড়া ভাঙছে। জিল ফোন করলে বলে দিই, না বাবা, এখন কোথাও যাবো না, ঘুমোবো।
জিলের দশটায় আসার কথা থাকলেও সে তার বান্ধবী নাতালিকে নিয়ে আগেই চলে আসে হোটেলে। আইফেল টাওয়ার দেখতে যেতে হবে। নাতালি মেয়েটির ডাগর ডাগর চোখ, মুখে মিষ্টি মিষ্টি হাসি। মেয়েটিকে আমার বেশ ভাল লাগে। জিল বলেছিল যদিও তারা একসঙ্গে থাকে, এখনও নাকি তার সঙ্গে নাতালির গভীর কোনও ভালবাসা হয়নি। এ খুবই সত্য কথা যে একসঙ্গে থাকলেই এক বিছানায় ঘুমোলেই ভালবাসা গড়ে ওঠে না। আমরা কিছুদূর হেঁটে একটি ট্যাক্সি নিয়ে আইফেল টাওয়ারের কাছে গেলাম। তিনতলা বন্ধ হয়ে গেছে টাওয়ারের, উঠলে তিনতলায় ওঠাই ভাল। আমার কিন্তু অত চুড়োয় ওঠার কোনও তীব্র ইচ্ছে নেই। দূর থেকেই দেখি না কেন! আলো ঝলমল পরিবেশটি আমার ভাল লাগে। আজদাহা টাওয়ারটি লোহা লককরের একটি স্তম্ভ। জানি না কেন লোকে এটি পছন্দ করে। প্যারিসের লোকেরা অবশ্য এটিকে জঘন্য একটি জিনিস বলে ছো! ছো! করে। ১৮৮৯ সালে প্যারিসের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর জন্য গুস্তাব আইফেল নামের এক লোক এটি বানিয়েছিলেন, তিনশ মিটার লম্বা টাওয়ারটি, সাত হাজার টন ওজন। কথা ছিল প্রদর্শনীর পর এটি তুলে ফেলা হবে। কিন্তু শেষ অবদি তোলা হয়নি, রয়ে গেছে। এলাকাটি, জিল বলে, ধনী। ধনীর ছেলেরা একটুকরো চাকাঅলা কাঠের ওপর চড়ে ভয়ংকর ভাবে দৌড়োচ্ছে। গরম পড়তেই নাকি এখানে এমন শুরু হয়ে যায়। আমরা নৌকো চড়ব বলে নদীর কাছে গিয়ে দেখি নৌকো নেই। এ কারণে যে মন খারাপ হবে তা নয়। আমার ওরকম হাঁটতেই ভাল লাগছিল। পাশাপাশি তিনজন। ভাল লাগছিল রকমারি মানুষের ভিড়। আনন্দিত মুখ। হাঁটতে হাঁটতে আমরা আর্ক দ্য ট্রায়াম্ফএর কাছে পৌঁছে যাই। জিল আর নাতালি দুজন বাড়িতে খেয়ে এসেছে। আমার রাতের খাওয়া তখনও হয়নি বলে শাঁর্লস এ লিজের এক রেস্তোরাঁয় বসি। ভেতরে নয়, বাইরে, তেরাসে। অনেক রাত অবদি। রাত গভীর হলেও বোঝার উপায় নেই। হৈ হুল্লোড়, মানুষের ভিড়, যানবাহনের ভিড়। কি অদ্ভুত এক অন্যরকম জগতের মধ্যে আমি!
পরদিন। সকালে ক্যামেরুনের সাংবাদিকের সঙ্গে নাস্তা খাওয়ার কথা। ধুৎ কি নাস্তা খাব। সকালে বিছানায় বসে চা খাচ্ছি আরাম করে। ক্যামেরুনের কথা আপাতত ভুলে যাই। ক্রিশ্চান বেস অপেক্ষা করছেন নিচে। আবার জিলের ফোন। ক্রিশ্চান এসেছে খবরটি দিলে জিল বলল, ‘তাহলে তুমি ক্রিশ্চানকে নিয়েই রেডিওতে চলে যাও। আমি তোমাকে নিয়ে আসতে গেলে দেরি হয়ে যেতে পারে। আমি আমার এখান থেকেই তাহলে সোজা রেডিওতে চলে যাচ্ছি।’ খানিক পর আবার জিলের ফোন। জ্ঞপ্রযোজক নেই এখন রেডিওতে, তোমার ওখানে গেছে কী না, খানিকক্ষণ অপেক্ষা কর।’ ক্রিশ্চানের সঙ্গে চা কফি নিয়ে বসলাম আধঘন্টা মত। ক্রিশ্চান বার বারই একটি কথা বলল, ‘আমি তোমার নামের জন্য তোমার বই ছাপতে চাইছি না। ছাপতে চাইছি তোমার সাহিত্যের জন্য। লেখক হিসেবে তোমাকে চাইছি। তোমাকে ফতোয়া দিয়েছে, তোমার এখন চারদিকে নাম, সেজন্য তাড়াহুড়ো করে তোমার একটি বই ছেপে হটকেকের মত বিক্রি করে তোমায় ভুলে যেতে চাইছি না। সত্যি কথা বলতে কী, তুমি যে লেখক, তুমি যে ভাল একজন লেখক, তা মানুষকে জানাতে চাইছি।’ রেডিওর লোকের জন্য বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। আমরা উঠে পড়ি। ক্রিশ্চান আমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যেতে এসেছেন। ছোট্ট একটি লাল গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁর প্রেসিডেন্ট উইলসন রোডের বাড়িতে। অসম্ভব রকম কর্মঠ তিনি, অবসর বলতে কিছু তাঁর জীবনে নেই। ক্রিশ্চান অনর্গল কথা বলেন। কোনও একটিও কিন্তু বাজে কথা নয়। ফরাসিরা কথা বলতে গেলে হাত পা মুখ মাথা ঠোঁট চোখ খুব নাড়ে। এটা ওদের সম্ভবত জাতীয় অভ্যেস। এডিশন দ্য ফামের মহিলা মিশেল ইডেল ফোন করছে, দেখা করতে চাইছে শুনে ক্রিশ্চান নাক সিঁটকে বলল, জ্ঞনারীবাদ নারীবাদ নারীবাদ। উফ! অসহ্য। নারীবাদ নিয়ে যারা লাফায়, আমি তাদের সহ্য করতে পারি না। এ হচ্ছে একধরনের সীমাবদ্ধতা। এও আরেক ধরনের মৌলবাদ। যে কোনও কিছুতেই আমরা নারী আমরা নারী। নারীর এই হয়নি সেই হয়নি। এই চাই সেই চাই। এই হতে হবে সেই হতে হবে। এ আবার কী! মানুষের কথা ভাব, মানুষের জন্য বল, মানুষের জন্য কর, নারী পুরুষ শিশু সবার কথা ভাব! কেবল নারীরই কি সব সমস্যা? শিশুদের নেই? পুরুষের নেই? হু!নারীবাদীদের উদ্দেশ্য নারী নিয়ে ব্যবসা করা, আর কিছু নয়।’
ক্রিশ্চান রাস্তার কিনারে গাড়ি রেখে তাঁর বাড়ির সামনের সড়কদ্বীপে বাজার বসেছে, সেখানে যায়। বাজারটি এই দ্বীপে বুধবার আর শনিবারে বসে। দুপুরের মধ্যেই বাজারটি উঠে যাবে। আবার সব ঝকঝকে তকতকে আগের মত। বিকেলে দেখলে কারও বোঝার উপায় থাকবে না এখানে একটি জমজমাট বাজার ছিল সকালবেলা। আমাদের কাঁচা বাজারের মত নয় এটি। সবকিছুর এখানে নির্ধারিত দাম। আমাদের দেশের মত চিৎকার করে দরদাম করতে হয় না। ক্রিশ্চান ফুল কেনে। লিলি অব দ্য ভ্যালি। চমৎকার ঘ্রাণ ফুলের, ছোট শাদা ফুল। ক্রিশ্চানের বাড়িটি তিনতলায়। এমন সুন্দর বাড়ি আমি জীবনে কমই দেখেছি। যেন বাড়ি নয়, আস্ত একটি মিউজিয়াম। সাতশ সিসি মেফেয়ার গাড়িটি দেখে মনেই হয়নি তাঁর বাড়িতে আছে খৃষ্টপূর্ব চারশ শতাব্দির প্রাচীন মূর্তি, ব্যাবিলিয়ন, সুমেরিয়ান সভ্যতার অমূল্য সব সম্পদ। প্রাচীন সব রঙিন পাথরের অলংকার। মিশরের গুহা থেকে তুলে আনা সেই আমলের জিনিসপত্র। আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি মূর্তিগুলোর সামনে, যেমন থ হয়ে ছিলাম ল্যুভরে। বাড়িটির দেয়ালে দেয়ালে যত তেলচিত্র আছে, সবই বড় বড় শিল্পীর। সবই আসল, নকল বলতে কিছু নেই। বাড়ির আসবাবপত্রগুলোও শিল্পীর তৈরি। যে কাপে চা খেতে দিল, সেটিও কয়েকশ বছর আগের। অ্যান্টিকে বাড়িটি ভর্তি। একটি অ্যান্টিক ল্যাণ্ডও আছে। অমিতাভ ঘোষের অ্যান্টিক ল্যাণ্ড বইটি ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছেন ক্রিশ্চান নিজে। বইটির নামে ইজিপ্ট দেখে আমি ধন্দে পড়ি। ক্রিশ্চান বললেন বাণিজ্যিক কারণে তিনি নামটি পাল্টে দিয়েছেন। বাণিজ্যিক শব্দটি উচ্চারণ করতে এখানে কারও কোনও গ্লানি নেই। আমার চা খাওয়া শেষ হয়নি। টেলিভিশনের লোকেরা এল। জ্যঁ শার্ল বারথেয়ারও এল। একবার বাংলায় একবার ইংরেজিতে সাক্ষাৎকার নিল ওরা। এরপর নিচে, খানিকটা হেঁটে গিয়ে মডার্ন মিউজিয়ামের বারান্দায় আরেক দফা সাক্ষাৎকার। হাঁটছি, কথা বলছি, ক্যামেরা আমার প্রতি অঙ্গভঙ্গি তুলে রাখছে।