আমরা জোন অব আর্কের ঘোড়ায় বসা সোনালী মূর্তির কাছেই একটি ক্যাফেতে বসি। এও বাইরে। ফটোগ্রাফার ভাল ইংরেজি জানে না। আধো আধো করে বলার চেষ্টা করল কিছু। এখানে, ফ্রান্সে, বেশির ভাগ মানুষই ইংরেজি ভাষাটি জানে না। সভ্য হতে গেলে যে ইংরেজি জানতে হয় না, তা ফ্রান্সে এসে আমার বেশ ভাল করেই বোধ হয়। উপমহাদেশেই এই ধারণাটি বদ্ধমূল, দুশ বছর ইংরেজ শাসনে থেকে এই হয়েছে মানসিকতা। প্রভুর ভাষা শিখে জাতে ওঠার তপস্যা।
সন্ধেটা হোটেলে বিশ্রাম নিতে গিয়ে দেখি ঘুমে ঢলে পড়ছি। কিন্তু অসময়ে ঘুমোলে চলবে কেন! এখানকার সময়ের সঙ্গে আমার শরীরকে মানিয়ে নিতে হবে। রাত নটায় জিল এসে ডেকে নিয়ে গেল। হোটেল থেকেই ট্যাক্সি ডাকে জিল। দু মিনিটের মধ্যে ট্যাক্সি এসে দরজার সামনে দাঁড়ায়। আমরা চলে যাই দূরে কোথাও। ঝলমলে রেস্তোরাঁ এলাকায়। খেতে খেতে দুজন রাজ্যির গল্প করি। বিকেলে ক্রিশ্চান এসেছিল হোটেলে, আমাকে পায়নি। চিঠি লিখে গেছে, যে ভিলেজ ভয়েজ এর এক সময়ের মোস্ট ইম্পর্টেন্ট নারীবাদী লেখক মারিন ওয়ারনার আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। শুনে জিল বলে, কিছু হলেই বলে ফেলে মোস্ট মোস্ট মোস্ট। ওই লেখকের নাম আমি কখনও শুনিনি। ক্রিশ্চানের সব উচ্ছাসকে জিল বলে, সব টাকার জন্য, সব ব্যবসার কারণে। যারা আন্দোলন করছে, নারীর জন্য লড়াই করছে, বই তাদের দেওয়া উচিত, আদর্শ বলে কথা। ব্যবসায়ী প্রকাশককে তোমার বই দিও না। জিল যখন ক্রিশ্চানের সামনে বলেছিল যে আমাকে স্ট্রাসবুর্গ যেতে হবে, ক্রিশ্চান লাফিয়ে উঠেছিল আনন্দে, জিল ওই আনন্দকেও বলেছে, ছো! সব টাকার জন্য। তোমাকে খুশি করে তোমার কাছ থেকে বই বাগাতে চাইছে। এই উদ্দেশ্য। টাকা টাকা টাকা। জিল হেসে, হঠাৎ বলল, আমি এই নতুন চাকরিতে ভাল করতে পারছি না।
–নতুন চাকরি?
–হ্যাঁ তোমার প্রাইভেট সেক্রেটারির চাকরি।
জিলের মপোলিয়েঁ ফিরে যাবার কথা ছিল। কিন্তু আমার জন্য চার তারিখ পর্যন্ত থেকে যাচ্ছে ও প্যারিসে। রাত তখন সাড়ে বারো। ভিড় উপচে পড়ছে রেস্তোরাঁগুলোয়। ছেলে মেয়েরা হাতে হাত ধরে রাস্তায় হাঁটছে। ঝলমলে আনন্দ চারদিকে। হঠাৎ দেখি নাকের সামনে একটি তাজা লাল গোলাপ। গোলাপটি বাড়িয়ে ধরে থাকা লোকটিকে দেখি। চোখে চোখ পড়ে। লোকটিকে বাঙালি মনে হচ্ছে। ফুল কিনব কি কিনব না তা না জেনেই লোকটি দ্রুত সরে গেল সামনে থেকে। লক্ষ করি, দূর থেকে আবার পেছন দিকে তাকাল আমার দিকে। লোকটি কি চিনতে পারল আমাকে! সম্ভবত! অথবা আমি যে তার দেশ অথবা তার পাশের দেশ থেকে এসেছি, সে সম্পর্কে সে নিশ্চিত। –লোকটি কি বাংলাদেশি! জিল জিজ্ঞেস করে।
–আমার কিন্তু তাই মনে হচ্ছে।
চারদিকে কলকলে আনন্দের মধ্যে, শাদা শাদা হাস্যোজ্জ্বল ফরাসিদের মধ্যে একটি বিষণ্ন বাদামী মুখ, ফুলঅলাটির মুখটি মনে পড়তে থাকে।
–আমার খুব খারাপ লাগে, খুব কষ্ট হয় যখন দেখি আমাদের দেশের ছেলেরা ইওরোপ আমেরিকায় এসে রেস্তোরাঁয় বাসন মাজে, রাস্তায় ফুল বিক্রি করে। শিক্ষিত লোকেরাও সোনার হরিণের সন্ধানে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
জিল চোখ বড় বড় করে বলে, বাহ! খারাপ লাগবে কেন! তুমি তো পছন্দ কর দেশের বাইরে যাওয়া।
বললাম, সে তো বেড়াতে। এরকমভাবে, বাসন মাজতে, ঝাড়ু দিতে, ময়লা পরিষ্কার করতে আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকেরা ধনী দেশগুলোয় দৌড়োচ্ছে।
জিল বলল, বোধহয় কাজ নেই দেশে, তাই।
একটু জোরেই বলি, দেশে থেকে কাজ করার জন্য চেষ্টা তো করতে হবে। কাজ যেন পাওয়া যায় দেশে, সেরকম অবস্থা করার জন্য সংগ্রাম তো করতে হবে। যে লোকটিকে দেখলাম, সম্ভবত সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার ডিগ্রি করে এ দেশে এসেছে, এখন ফুল বিক্রি করছে। ফুল বিক্রি করার জন্য কি পদার্থবিজ্ঞান জানার দরকার হয়! মেধাগুলো পাচার হয়ে যাচ্ছে গরিব দেশ থেকে ধনী দেশে। দেশে থেকে দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের জন্য কে তবে চেষ্টা করবে যদি যুব সমাজ কি করে খানিকটা বেশি টাকা কামাবে, সেই কারণে যদি বিসর্জন দেয় সব আদর্শ!
জিল মাথা নাড়ল। সায় দিল আমার কথায়।
কথা ছিল আমি আর জিল নৌকো নিয়ে সেইন নদীতে ঘুরে বেড়াবো। কিন্তু আর ইচ্ছে করেনি সেইনে ভাসতে।
পরদিন উনত্রিশ তারিখ। উনত্রিশে এপ্রিলের ডায়রি আমাকে লিখতে হবে প্যারিসের বিখ্যাত পত্রিকা লা নভল অবজারভেতর এর জন্য। পত্রিকাটির সম্পাদক জঁ দানিয়েল ঢাকায় আমাকে অনেকগুলো ফ্যাক্স পাঠিয়েছেন ডায়রি লেখার জন্য অনুরোধ করে। পৃথিবীর বিখ্যাত সব লেখক ওতে লিখবেন। উনত্রিশ তারিখটি তাঁরা কেমন কাটিয়েছেন, তার বর্ণনা করে। এই দিনটিতেই আমাকে স্ট্রাসবুর্গে যেতে হবে। ক্রিশ্চান সকালেই ফোন করেছিল। শুভসকাল জানিয়ে বললেন কাল আসবেন তিনি আমাকে নিতে আরেকটি টিভি প্রোগ্রামের জন্য। সিগমার আরেকজন ফটোগ্রাফার আবার আসবে। সকালে গরম জলে গোসল করে গোলাপি একটি শাড়ি পরে নিই। প্যারিসে এই প্রথম আমার শাড়ি পরা। শাড়ি পরে শেষ করিনি, নিচ থেকে ফিলিপ ডেমেনএর আসার খবর দেওয়া হল। লা ভি নামে এক পত্রিকার সাংবাদিক এই ফিলিপ। হোটেলের নিচতলায় একটি ক্যাফে আছে, ক্যাফেতে বসি দুজন। নাস্তা খেতে খেতে সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর দিই। একই রকম প্রশ্ন, একই রকম উত্তর। এর মধ্যে জিল আসে বড় একটি লিস ফুলের তোড়া নিয়ে। কি যে ভাল লাগল চমৎকার ফুলগুলো দেখে। ফুল দেখলেই আমার নাক কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নেওয়ার অভ্যেস। লক্ষ করেছি, ফরাসিরা ফুলের সৌন্দর্য দেখে, ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য নাক বাড়ায় না তেমন। এখানকার ফুলে ঘ্রাণও খুব কম থাকে। বাণিজ্যিক কারণে ফুল ফোটানো হলে তাতে ঘ্রাণ কোথায় থাকবে! ফিলিপ তখনও যায়নি, এল লা ফিগারো পত্রিকার সাংবাদিক সঙ্গে ফটোগ্রাফার নিয়ে। হোটেলের কাছের রাস্তায় ছবি তুলল ফটোগ্রাফার। আমার হোটেলের নাম মারসেলিয়র অপেরা, অবশ্য যদি আমি উচ্চারণ করি। আমার উচ্চারণ শুনে একটি ফরাসিও বোঝে না কি বলছি আমি। আমাকে বানান করে দিতে হয় হোটেলের নাম। ওরা মাসেই অপেয়া জাতীয় কিছু একটা বলে। ফিগারোর সাংবাদিক মারি এমিলি লোমবার্ড সঙ্গে কথা বলার আমার সময় নেই, কারণ আমাকে যেতে হবে স্ট্রাসবুর্গ। জিল যাচ্ছে না স্ট্রাসবুর্গে, যেহেতু অন্য সাংবাদিকরাও যাচ্ছেন টিভি প্রোগ্রামের জন্য। তাছাড়া মারি এমিলি যাচ্ছে আমার সঙ্গে। জিল বলে দিল, অবশ্যই যেন স্ট্রাসবুর্গের ক্যাথিড্রালটি দেখি। মারি এমিলি আর আমি প্যারিসের অরলি বিমানবন্দর চলে গেলাম। মারিকে পথে জিজ্ঞেস করলাম, তোমারও কি কোনও প্রোগ্রাম আছে টিভিতে?