বরফের থালায় আমাদের জন্য ঝিনুক এল। দেখে আঁতকে উঠি। কি রে বাবা ঝিনুক খাবে কে! বারথেয়ার আর দোমিনিক ওয়াও ওয়াও বলে একের পর এক ওগুলো খেতে শুরু করল। ভেবেছিলাম ওয়াও শব্দটির পর বলবে কি বাজে। কিন্তু বলল ওয়ান্ডারফুল। কি করে এই বিদঘুটে জিনিসটি ওয়াণ্ডারফুল হয় জানি না। বহু কষ্টে গলায় উঠে আসা বমি আটকে রাখি। দুজনই আমাকে সাধাসাধি করে খেতে। আমি সোজা না বলে দিই। আমার না এ কাজ হয় না। দোমিনিক আমাকে যে করেই হোক ঝিনুকের স্বাদ নেওয়াবেই। আমার চোখ বন্ধ করল ওরা, নাক বন্ধ করল, এরপর মুখটি হাঁ করিয়ে ঢুকিয়ে দিল একটি আস্ত ঝিনুক। গলা বেয়ে সুরসুর করে চলে গেল জিনিসটি, যেন কারও একদলা থিকথিকে সর্দি গিলে ফেললাম। বারথেয়ারের অনেক খরচ হয়ে গেল এই রেস্তোরাঁয়। আমি টাকা দিতে চাইলে, বারথেয়ার আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তোমার বই অনুবাদ করার জন্য ম্যালা টাকা পেয়েছি আমি।
রাত দেড়টায় আমরা বেরোলাম রেস্তোরাঁ থেকে। রেস্তোরাঁ তখনও জমজমাট। প্যারিস কি ঘুমোয় রাতে! আমার মনে হয় না। বিদায় নেওয়ার সময় দোমিনিক আর বারথেয়ার জড়িয়ে ধরে চুমু খেল গালে। একদিনের পরিচয়ে গালে চুমু খাওয়া এ দেশে কোনও ব্যাপারই নয়। দোমিনিক আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে যায়। রাতে ভাল ঘুম হয় আমার। আন্তয়ান দ্য গুডমারকে ফোন করেছিলাম। আমি প্যারিসে শুনে খুশিতে চেঁচিয়ে বলল, ইনক্রিডবল। ইনক্রিডবল শব্দটি এরা খুব ব্যবহার করে। ক্রিশ্চান বেসকে ফোন করলেও ও বলেছে, ইনক্রিডবল, তুমি প্যারিসে! সকালে আন্তোয়ান এল হোটেলে। আমাকে নিয়ে কাছেই একটি ক্যাফেতে গেল নাস্তা খেতে। ঝকঝকে রোদ উঠেছে। আন্তোয়ান রোদ দেখে বারবারই বলছে, আহ, কি চমৎকার দিন আজ। কি সুন্দর রোদ!
উফ, রোদ আমার ভাল লাগে না। আমি রোদ থেকে গা বাঁচিয়ে ছায়া ধরে হাঁটি।
কি বল! রোদ ভালবাসো না তুমি!
–নাহ।
–আমাদের এখানে উৎসব শুরু হয়ে যায় রোদ উঠলে। বসন্তের প্রথম রোদ। তুমি যেন তোমার দেশের চমৎকার রোদ এই ঠাণ্ডা মেঘলা স্যাঁতসেঁতে প্যারিসে নিয়ে এলে! তোমাকে ধন্যবাদ।
–রোদ নিয়ে কী ভীষণ উচ্ছাস তোমাদের। আমি রোদের দেশের মানুষ। রোদ আমাদের গা পুড়িয়ে দেয়।
–আমাদের সূর্য ভাল লাগে।
–আমাদের চাঁদ ভাল।
–এখানে রোদ মানে আনন্দ। রোদ মানে সুখ।
–ওখানে রোদ মানে জ্বালা পোড়া, রোদ মানে অশান্তি। ছায়া আমাদের প্রাণ জুড়োয়।
কি পার্থক্য তাই না! আবহাওয়া নিয়েই গুডমার কথা বলল আধঘন্টা। বৃষ্টি ভাল লাগে আমার। বৃষ্টি অসহ্য গুডমারের। মেঘলা দিনকে গুডমার,কেবল গুডমার নয়, এখানকার সবাই, বলে খারাপ দিন। আমি বলি চমৎকার দিন। গুডমার আমাকে তার পত্রিকা দিল, লিবারেশন। এটি ফ্রান্সের বামপন্থী পত্রিকা। লিবারেশনে আমার প্যারিসে আসার খবর ছাপা হয়েছে। গুডমার ঢাকায় গিয়ে আমার যে সাক্ষাৎকার নিয়েছিল, সেটি যে দু পাতা জুড়ে বিশাল করে ছাপা হয়েছিল এ পত্রিকায়, সে লেখাটিও দিল। পত্রিকা খুলে নিজের ছবি আর নাম ছাড়া কোনও কিছু আমার পক্ষে চেনা সম্ভব হয় না। ভাষা রোমান হরফে, কিন্তু ভাষার খুব বেশি কিছু উদ্ধার করতে আমি পারি না। ক্যাফে থেকে হোটেলে ফিরে দেখি ক্রিশ্চান বেস আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। ক্রিশ্চানের বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে, অত্যাধুনিক পোশাক পরা সোনালী চুলের মাদাম, ফরাসি অ্যারিস্টোক্রেট। কিন্তু গাম্ভীর্যের বিন্দু মাত্র কিছু নেই। হই হই করা মানুষ তিনি। চকাশ চকাশ করে দু গালে চুমু খেয়ে তিনি আমাকে কাছের আরেকটি ক্যাফেতে নিয়ে গেলেন নাস্তা খেতে। ক্যাফের ভেতরে যেতে চাইলে না না করে উঠলেন ক্রিশ্চান। বাইরের রোদে বসবেন তিনি। ক্যাফের সামনে রাস্তার ওপরের ফুটপাতে চেয়ার পাতা, ওখানে রোদ পড়েছে, রোদে বসে গুডমারও খেয়েছে, ক্রিশ্চানও খেলেন। প্যারিসের এই হল সৌন্দর্য। গরম শুরু হতে না হতেই ক্যাফে রেস্তোরাঁগুলোর বাইরে পাতা চেয়ার টেবিলে খেতে বা পান করতে কিলবিল ভিড় লেগে যাবে।
লম্বা একধরনের রুটি আছে, ফরাসিরা এই রুটিকে বাগেত বলে। এটি তাদের খুব প্রিয় রুটি। বগলে করে একটি বাগেত নিয়ে লোকেরা রাতে বাড়ি ফেরে। অথবা সকালে ঘুম ঘুম চোখে বেরিয়ে মোড়ের বুলোনজরি থেকে একটি সবে বানানো গরম বাগেত কিনে বগলে করে বাড়ি যায়। বাগেত খেতে আর যে কোনও রুটির মতই স্বাদ। আমি জানি না, কেন ছোট রুটি না বানিয়ে দু হাত লম্বা রুটি বানাতে হয় এদের। ট্রাডিশন বলে একটি ব্যাপার আছে, ফরাসিরা তা সহজে হারাতে চায় না। কত রকম যে রুটি আছে এই দেশে! ক্রিশ্চান সকালে ক্রোসোঁ বলে একটি শঙ্খের মত দেখতে রুটি খাচ্ছেন, সঙ্গে কালো কফি। এই হল তাঁর সকালের নাস্তা। অনর্গল বকতে পারেন তিনি। ইংরেজি বলেন কড়া ফরাসি উচ্চারণে। বার বার করে জানতে চাইছেন আমার ফ্রান্সের প্রোগ্রাম। কবে হবে, কখন হবে, কোথায় হবে, কী হবে — সব তিনি জানতে চান। আমি, সত্যি কথা বলতে কি জানিও না আমার কখন কোথায় কি অনুষ্ঠান আছে। ক্রিশ্চানকে বড় আন্তরিক মনে হয়। দুজন খেয়ে দেয়ে হোটেলে ফিরে দেখি বারথেয়ার অপেক্ষা করছে। মোটা একটি বই এনেছে রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের আঁকা একটি ছবি দেখালো, এটি নাকি লজ্জার পঈচ্ছদ হবে। এরপরই জিল এল আমাকে নিতে। বারথেয়ারকে বিদায় দিয়ে জিল ট্যাক্সি ডাকল, সোজা আমাকে নিয়ে গেল রেডিও ফ্রান্সে। রেডিওতে সাক্ষাৎকার দিতে হল। জিল বলল যে তিন তারিখে রেডিওতে নাকি আমার আরেকটি সাক্ষাৎকার আছে। জিল জানে সব।ও জানে কখন কোথায় আমাকে যেতে হবে। রেডিও থেকে নিয়ে গেল একটি পত্রিকা আপিসে। সুন্দর গোছানো ছিমছাম আপিস। বড়। গাদাগাদি করে বাংলাদেশের পত্রিকা আপিসে যেমন সাংবাদিকরা বসে, সেরকম নয়। ওখানেও সাক্ষাৎকার। এরপর দুজন বেরিয়ে ক্যাফের বাইরে বসে দুপুরের খাবার খেলাম। খেয়ে হোটেলে ফেরার পর দেখি সিগমা নামের ফটো এজেন্সি থেকে ফটোগ্রাফার এসে বসে আছে, ফটো তুলবে আমার। হোটেলে তুলবে না, বাইরে তুলবে। বাইরের রোদে। ফটোগ্রাফার তার গাড়ি করে আমাদের নিয়ে গেল ল্যুভর মিউজিয়ামের সামনের বাগানে। কচি কলাপাতা রঙের সবুজ ঘাসে ফুটে আছে শাদা শাদা ফুল। গায়ে অনেক পাপড়ি। প্রেমিক প্রেমিকারা এই ফুলের পাপড়িগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে একটি খেলা খেলে। পাপড়ি ছেঁড়ে আর বলে, তোমায় আমি ভালবাসি, খুব ভালবাসি, পাগলের মত ভালবাসি, ভালবাসি না। ছিঁড়তে ছিঁড়তে যে পাপড়িটি একদম শেষে গিয়ে ছিঁড়বে সেটিই হবে মনের কথা। ছবির জন্য বিভিন্ন মূর্তির সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে, আর আমার থেকে থেকে চোখ চলে যাচ্ছে ফুলের দিকে। বাগানের ভেতর যুবক যুবতী চুমু খাচ্ছে। খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। গভীর চুমু। এই চুমুর নামই বোধহয় ফরাসি চুমু। দীর্ঘক্ষণ এত ঘন হয়ে বসে এইযে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে গভীর করে চুমু খাচ্ছে, খেয়েই যাচ্ছে, তড়িঘড়ি কোনও কর্ম সারার কথা, দেখে মনে হয়, মোটেও ভাবছে না। পাশ দিয়ে এত লোক হেঁটে যাচ্ছে, কেউ একবার ফিরেও তাকাচ্ছে না চুমু খাওয়া জোড়ার দিকে। বাংলাদেশে হলে ভিড় লেগে যেত। জোড়া তো ছাড়াতোই লোকে, দুজনের হাত পায়ের জোড়াও ভেঙে দিত মেরে।