ল্যুভর মিউজিয়ামটি সেইন নদীর পাড়ে। আশ্চর্য এই মিউজিয়ামটি বাইরে থেকে ঘন্টার পর ঘন্টা দেখলেও দেখা ফুরোবে না। এমনই নিখুঁত স্থাপত্য এর। বিশাল এই বাড়িটির গায়ে গায়ে মূর্তি বসানো। হোটেল দ্য ভিলের গায়েও মূর্তি বসানো। প্রথম যখন চমৎকার বাড়িটির নাম জিল বলল হোটেল দ্য ভিল, আমি তো ভেবেইছিলাম এটি সত্যিই কোনও হোটেল, যেখানে লোকে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। আরে তা হবে কেন! ওটি টাউন হল। প্যারিস শহরের মেয়রের আপিস। সরকারি এরকম বাড়িগুলোকে ফরাসিরা হোটেল বলে। বেসরকারি কিন্তু বড় কোনও বাড়ি হলেও বলে, যেমন হোটেল পারতিকুলিয়ে।
জ্যাঁ শার্ল বারথেয়ার আর দোমিনিক আমাকে নিয়ে গেল ল্যুভর মিউজিয়াম দেখাতে। জ্যাঁ শার্ল এসেছিল হোটেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে। বারথেয়ার আমার অনুবাদক। লজ্জা বইটি অনুবাদের কাজ নিয়েছে সে। বারথেয়ার আর দোমিনিক আমার দুপাশে, আমি জগতের সকল বিস্ময় নিয়ে দেখছি ল্যুভর মিউজিয়াম। অর্ধেক দিন মিউজিয়ামে হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ব্যথা হয়ে যায়, তবু মিউজিয়ামের হাজার ভাগের এক ভাগও দেখা হয় না। পুরোনো তেলচিত্রগুলো সেই সতেরো আঠারো শতাব্দির, প্রধানত যীশুর ছবি। যীশুর মুখমাথা থেকে আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। আধন্যাংটো যীশুই দখল করে আছেন তখনকার শিল্পকলা। আজদাহা সব ক্যানভাস। আর কি যে নিখুঁত সব কাজ! একটি ছবিতে যীশু আর তাঁর পাশে অনেকগুলো লোক, কেউ খাচ্ছে, কেউ গান গাইছে, কারও কারও আবার ভীষণ রকম উদ্বিগ্ন মুখ। দোমিনিককে জিজ্ঞেস করি, এই দৃশ্যের গল্পটি বলতে। দোমিনিক বলল যে ধর্ম সম্পর্কে খুবই কম জানে সে। আমি যখন প্রশ্ন করে উত্তর পাচ্ছি না, তখন ভিড় থেকে এক লোক এসে বলল, মানুষগুলো সবসময় যে বাইবেলের চরিত্র তা নয়, শিল্পী যীশুর আশেপাশের লোকজনের মুখে তখনকার নামকরা সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মুখ বসিয়ে দিতেন। কখনও কখনও আবার দেখা যায় ভিড়ের মধ্যে ধর্মের লোকজনের মধ্যে আকারে ছোট একটি মানুষ, সে মানুষটি হয়ত তিনি, যিনি শিল্পীকে দিয়ে এই ছবি আঁকিয়েছিলেন। পয়সার বিনিময়ে ছবি আঁকতে গেলে অনেক অনুরোধ মেনে চলতে হয়। রাজা বাদশারা বা ধনী লোকেরা শিল্পীদের দিয়ে ছবি আঁকাতেন, শর্ত থাকত যীশুর পায়ের কাছে কোনও কিনারে যেন তাঁরা খানিকটা শোভা পান। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে সেই সব মুখ এখনও শোভা পাচ্ছে ক্যানভাসে, ধর্মের গল্পের অংশীদার হয়ে।
দোমিনিকের সঙ্গে শিল্প সংস্কৃতি নিয়ে কথা হয়, বারথেয়ারের সঙ্গে তেমন হয় না। বারথেয়ার না জানে ইংরেজি, না জানে বাংলা, যদিও সে দাবি করে যে সে বাংলা জানে। এ পর্যন্ত একটি বাংলা শব্দও আমি তার মুখে উচ্চারিত হতে শুনিনি। আমি বেশ কয়েকবার বাংলায় কথা বলতে চেয়েছি, জিজ্ঞেস করেছি, আপনি কি অনুবাদ শুরু করে দিয়েছেন? বাংলা ভাষা শিখেছেন কোথায়? এসবের উত্তরে আচমকা ঠা ঠা করে হেসে উঠেছে সে। এখন তার যা বলার ইচ্ছে তা সে ফরাসি ভাষায় দোমিনিককে বলছে, দোমিনিক তা অনুবাদ করে আমাকে শোনাচ্ছে। আমার ভয় লাগে ভেবে যে এই বাংলা না জানা লোকটি লজ্জা বইটি বাংলা থেকে ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করবে, কেবল করবে না, অনুবাদ নাকি শুরুও করে দিয়েছে। আমি নিশ্চিত, লোকটির দ্বারা আর যাই হোক, অনুবাদ হবে না। যাই হোক, ওতে আমি আপাতত মন দিচ্ছি না, মন দিচ্ছি শিল্পে। চারদিকে যীশুর এত ন্যাংটো ন্যাংটো ছবি দেখে তাকে কিন্তু ধর্মের লোক বলে মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে পর্নোগ্রাফির চরিত্র। শেষে একটি মন্তব্য করলাম, ধর্মের প্রয়োজন শিল্পের জন্য, জীবনের জন্য নয়। দোমিনিক সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিল আমার কথা। বলল, ধর্ম মানুষকে নানারকম কল্পনা দিয়েছে। কল্পনাকে ভিত্তি করেই এইসব আঁকাআঁকি।
–দোমিনিক, তুমি কি বাহবাটা শেষ পর্যন্ত ধর্মকে দিতে চাইছো? আমি কিন্তু মানুষকে দিতে চাইছি সবটুকু কৃতিত্ব। মানুষই ধর্ম সৃষ্টি করেছে। মানুষই ধর্ম নিয়ে ছবি একেঁছে, বই লিখেছে। মানুষের ভেতর প্রতিভা ছিল বলেই না এসব করতে পেয়েছে।
১. প্যারিসের ডায়রি – ০২
রাতে জঁ শার্ল বারথেয়ার খাওয়াবে আমাকে। জিল চলে গেছে জিলের বান্ধবীর বাড়ি। সে ক্লান্ত। বারথেয়ার, দোমিনিক আর আমি মোঁপারনাসে ক্লজারি দ্যা লিলা নামের একটি বিখ্যাত রেস্তোঁরায় খেতে গেলাম। এটি বিখ্যাত এই জন্য যে, এখানে একসময় কবি সাহিত্যিক শিল্পীরা আড্ডা দিতেন। উনিশ শতকের শুরুর দিকে আমেরিকায় মদ নিষিদ্ধ করার ফলে অনেক আমেরিকান লেখক প্যারিসে চলে এসেছিলেন। তাঁরা এই বাধানিষেধহীন স্বপ্নপুরীতে বসে মহানন্দে মদ খেতেন। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তো এই রেস্তোরাঁয় বসে পুরো একটি বই লিখেছেন। প্যারিসে এরকম বহু ক্যাফে আছে, যেখানে শিল্পী সাহিত্যিক দার্শনিকরা ক্যাফে সংস্কৃতির শুরু করেছিল।
রেস্তোরাঁটিতে দেখছি ছেলেমেয়েরা মদ খাচ্ছে, পরস্পরকে জড়িয়ে ধরছে, চুমু খাচ্ছে। কেউ ওদের দিকে তাকাচ্ছে না। আমি তাকাই। চোখ মেলে দেখি সব। কি চমৎকার পরিবেশ। ইচ্ছেগুলোকে কেউ দমন করছে না। চুমু খেতে ইচ্ছে করছে, খাচ্ছে। চোখ কপাল কুঁচকে মুখে রাগ ঘৃণা হিংসা নিয়ে বসে থাকা ঝগড়া করা মানুষ দেখার চাইতে তো হাসি মুখের খুশি মুখের প্রেম দেখা চুমু দেখা অনেক ভাল। মন ভাল হয়ে যায়। পৃথিবীকে বড় সুন্দর মনে হয়। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয়।