বন্দর থেকে বাইরে বেরোলেই তেরো ডিগ্রি সেলসিয়াস। একটি শীত শীত সুই আমার গায়ে বিঁধল এসে। জিল তার গায়ের কোটটি খুলে আমার পিঠে ছড়িয়ে দিল। আমরা গাড়ি করে প্যারিসের দিকে যাচ্ছি। গাড়ি খুব দ্রুত চলছে, সব গাড়িগুলোই খুব দ্রুত চলে এখানে। হোবিয়া মিনা আর জিল দুজন অনর্গল কথা বলছে, জিল দেখছি নোট করে নিচ্ছে যা যা কথা হচ্ছে, লম্বা একটি কাগজ ভরে গেল লিখতে লিখতে। মাঝে মাঝে জিল আবার অনুবাদ করে দিচ্ছে আমাকে, ‘তোমার সঙ্গে একজন দেখা করতে চাইছে, এডিশন দ্য ফাম থেকে, উনি আবার মন্ত্রীও।’ ফ্রান্সের মন্ত্রী দেখা করতে চাইছে! অবাক হই। আমি কি মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার যোগ্য! এরা হাজার বছরের শিক্ষিত। আর আমার বংশে আমার নানা দাদা দুজনই টিপসই এর চেয়ে বেশি যা পারতেন, তা নিজের নামখানা লিখতে কেবল। আমার বিশ্বাস হতে চায় না আমি এই জায়গায় এসে পৌঁচেছি। বিশ্বাস হতে চায় না পৃথিবীতে এমন সুন্দর কোনও শহর থাকতে পারে। নিজেকে ভুলতে থাকি আমি। আমার ভেতরে আর আমি নেই। যেন অন্য কেউ, অন্য কেউ অন্য কোনও গ্রহে। অথবা যেন ছবি সব। যেন এসব সত্য নয় প্যারিসের ভেতর যখন আমাদের গাড়ি চলছিল, ছবির মত লাগছিল। ছবিতে দেখেছি এমন সব দৃশ্য। প্যারিসে ঢোকা না তো আশ্চর্য সুন্দর একটি ছবির মধ্যে ঢুকে পড়া। এমন সুন্দর চারদিক, যে দেখতে দেখতে শ্বাস নিতে ভুলে যাচ্ছি। প্যারিসে শুনেছি বিখ্যাত অনেক যাদুঘর আছে, কিন্তু পুরো প্যারিসই যে আস্ত একটি যাদুঘর, তা আমার জানা ছিল না আগে।
আমার ঘোর কাটে না। আমার বিস্ময় কাটে না। যত দেখি প্যারিস, তত আরও দেখতে ইচ্ছে করে। শহরটিকে কুড়ি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। কিছু এলাকাকে বলা হয় ধনী এলাকা, কিছু এলাকাকে গরিব এলাকা। বেলভিল নামের এক গরিব এলাকা যখন আমাকে দেখানো হল, আমি আতি পাতি করে দারিদ্র খুঁজছিলাম। বিশাল বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট বাড়ি, বাড়িতে যারা থাকছে প্রায় সকলেরই গাড়ি আছে, সকলের পরনে সার্ট প্যান্ট, সকলের পায়ে জুতো, এরা আবার গরিব হবে কেন!
–গরিব এলাকা দেখাবে বলেছিলে? জিলকে জিজ্ঞেস করি।
–ওই তো দেখালাম। এতক্ষণ কি দেখলে!
–একে তোমরা গরিব এলাকা বল! আমি হেসে উঠি। আমার চোখে দেখা আর ফরাসিদের চোখে দেখা দারিদ্রে আকাশ পাতাল পার্থক্য।
জিল আমাকে নিয়ে গেল একটি ব্রাসারিতে দুপুরে খাওয়াতে। ব্রাসারির ভেতর একটি বার। তাকে সারি সারি মদের বোতল সাজানো। জিল জানি না কি খাবার দিতে বলেছে দুজনের জন্য। অদ্ভুত খাবার, কখনও খাইনি আগে। আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব হয় না। ক্ষিধে ছিল পেটে, কিন্তু মন এমন ভরে আছে প্যারিসের সৌন্দর্যে! পেটের ক্ষিধে যে কোথায় উবে গেছে কে জানে।
জিল আমাকে নিয়ে গেল শাঁ জার্মা দি প্রের একটি ক্যাফেতে। বিখ্যাত ক্যাফে। ক্যাফে দ্য ফ্লোর। জিলের বোন দোমিনিক অপেক্ষা করছিল ওখানে আমাদের জন্য। ক্যাফেটিতে একসময় জ্যাঁ পল সাষর্ন আর সিমোন দ্য বোভোয়া বসতেন, আড্ডা দিতেন, লিখতেন, সাহিত্য আর দর্শন নিয়ে বক্তৃতা করতেন। ওঁদের নাম লেখা আছে চেয়ারের পিঠে, যে চেয়ারে দিনের পর দিন বসে কাটিয়েছেন। দোমিনিক আর জিলের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব। একজন আরেকজনের প্রশংসা করছে, আড়ালে। আর সামনে খুনসুঁটিতে ব্যস্ত। দুজন বড় হয়েছে হিপি পরিবারে। মা স্প্যানিশ গনজালেজ আর বাবা জার্মান ফরস্টার পরিবারের। হিপিরা সমাজের কোনও নিয়ম মেনে চলত না। জিল আর দোমিনিক ছোটোবেলায় বাবা মার কোনও রকম শাসন পায়নি। কোনো নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে ওরা জীবন যাপন করত না। কেউ বলেনি ওদের নাও খাও, পড়তে বসো, ঘুমোতে যাও বা কিছু। যখন যা ইচ্ছে করে জিলরা তাই করেছে। বাবা মাও তেমন। যেমন ইচ্ছে তেমন জীবন যাপন করেছে। কোনও বাঁধাধরা নিয়ম ছিল না কিছুতে। জিলের বাবা মা কখনও বিয়েই করেনি। ছেলেমেয়েরা বাবা মাকে নাম ধরে ডাকত। জিলও তার মাকে ক্লদিয়া বলে ডাকে। আশ্চর্য, ওই পরিবেশে বড় হয়েও জিল তার বাবা মা আর বোনের জন্য কি গভীর ভালবাসা পুষে রাখে। ওরাও জিলের জন্য।
যখন আমাকে জিজ্ঞেস করা হল, কী দেখতে চাই প্যারিসে। প্রথমেই আমি বললাম, মিউজিয়াম। র্যোঁদার ওপর একটি বই পড়া আছে আমার। র্যোঁদার ভাস্কর্যগুলো এখনও মনের ভেতর। জিল আর দোমিনিক আমাকে নিয়ে গেল র্যোঁদা মিউজিয়ামে। খুব সুন্দর এই মিউজিয়াম। র্যোঁদার ভাস্কর্যগুলো সামনে থেকে দেখি আর ভেবে কূল পাই না কি করে পাথর কেটে কেটে এমন সব আশ্চর্য সুন্দর মূর্তি গড়তে পারে কেউ। র্যোঁদার পুরো জীবনটি আমার চোখের সামনে ভাসতে থাকে। কি করে তিনি তার মডেল কন্যাদের ব্যবহার করেছেন কাজে। কামি কদেলকে খুঁজি তাঁর কাজে। ইচ্ছে করে ছুঁয়ে দেখি। না, এখানে কিছুই স্পর্শ করা যাবে না। ক্যামেরায় ছবি তুললে ফ্লাশ বন্ধ করে তুলতে হয়, কারণ ওই আলোয় শিল্পকর্ম নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কোথাও কোথাও এমন আছে যে হাজার বছর আগের গুহার ছবিগুলো দেখাও এখন সাধারণ মানুষের জন্য নিষিদ্ধ, কারণ মানুষের শ্বাস প্রশ্বাসের কারণে ছবি মলিন হয়ে যায়। মিউজিয়ামের বাইরে রাখা আছে র্যোঁদার ভাবুক মূর্তিটি। হাঁটুর ওপর কনুই রেখে চিবুকের নিচে হাত রেখে ভাবছে মানুষটি। রাখা নরকের দ্বারও। র্যোঁদার ভাস্কর্য দেখা শেষ হলে জিল নিয়ে গেল ভিক্টর উগোর বাড়িতে। প্লাস দ্য বোজ এ। মাঝখানে একটি মাঠ, আর চার কিনারে একরকম সব বাড়ি। এলাকাটি ধনী এলাকা। ধনীরা থাকতেন একসময়, এখনও ধনীরাই থাকেন। বাড়িগুলো মোটেও আমাদের বাড়ির মত নয়। এসব বাড়িতে কোনও ছাদ নেই। কেউ বিকেলবেলা ছাদে ওঠে না। ছাদগুলো কালো ইস্পাত বা সবুজ কপারে মাথা মুড়ে আছে, মাথার তলে ছোট ছোট ঘুলঘুলিগুলো পাখির নীড়ের মত। একসময় ওপরতলার ছোট ছোট ঘরে কাজের মেয়েরা থাকত। ফরাসি রেভুলেশনের পর শ্রেণীর তফাৎটি দূর হয়েছে। তুমি প্রভু, আমি ভৃত্য–এই ব্যাপার আর নেই। আহা এরকম একটি সমাজ যদি আমাদের দেশেও হত। ভিক্টর উগোর বাড়িটিতে তাঁর আঁকা ছবি, তাঁর লেখা পান্ডুলিপি দেখলাম। একটি জিনিস আমার খুব অবাক লেগেছে, তাঁর মেয়ে সেইন নদীতে পড়ে মারা যাওয়ার পর উগো এমনই ভেঙে পড়েছিলেন যে মেয়ের আত্মার সঙ্গে তিনি কথা বলতেন বলে ভাবতেন। টেবিলে টোকা পড়ত আর তিনি টোকাগুলো অনুবাদ করতেন। মাসের পর মাস বসে বসে অপ্রকৃতিস্থের মত কেবল অনুবাদ করতেন। মোটা মোটা খাতা ভরে ফেলেছেন লিখে মেয়ের আত্মার সঙ্গে তাঁর কথোপকথন। রবীন্দ্রনাথও প্ল্যানচ্যাট করতেন। জানি না বড় বড় মানুষগুলো বেশি বয়সে এসে এমন নির্বোধ হয়ে যান কেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ভিক্টর উগোর মিল অনেক। দুজনের মধ্যে বয়সে একশ বছরের তফাৎ। দুজনে সঙ্গীত ভালবাসতেন। দুজনে ছবি আঁকতেন। উগো প্রেমে পড়েছিলেন তাঁর দাদার প্রেমিকার, আর রবীন্দ্রনাথ প্রেমে পড়েছিলেন তাঁর দাদার স্ত্রীর। উগো কন্যার মৃত্যুতে শোকে বিহ্বল ছিলেন। রবীন্দ্রনাথও। দুজনই মানবতার কথা বলতেন।