জ্ঞপোস্টাপিসে অভিজ্ঞ লোকেরা থাকে, খাম দেখলেই বোঝে কোন খামের ভেতর চেক আছে।’
‘কিন্তু আমি এখন কি করে টাকা পাবো?’
‘আপনি পাবেন না।’ গলাটি এখন আরও শান্ত। নিশ্চিন্ত।
হলুদ হলুদ লাগে সবকিছু। সর্ষেফুলও বুঝি কারও চোখে এত হলুদ লাগে না।
‘তাহলে টাকাটা কিছুতেই আমার আর পাওয়া হচ্ছে না?’
মাথা নাড়লেন, ‘না’।
ব্যাংকারের ব্যাখ্যার পরও আমার ইচ্ছে করে না কোনও অন্যায় চুপচাপ মেনে নিতে। জাতীয় ডাকঘর আপিসে নিজে গিয়ে এর মাথার কাছে আমার শান্তিনগরের বাড়ির ঠিকানার চিঠি যে চুরি হয়েছে বলি। তিনি আমাকে লিখিত অভিযোগ দিতে বলেন। তাও দিই। মাথার কোনও মাথাব্যথা নেই আমার চিঠি আর চিঠির পেটের চেক চুরি হওয়া নিয়ে। তদন্তের কোনও রিপোর্ট আমার কোনওদিনই পাওয়া হয় না। তদন্ত করতে কেউ ডাকঘরে যান না, তবে তদন্ত করতে আমার বাড়িতে আসেন। যখন হতাশা আমাকে ভাসাচ্ছে ডোবাচ্ছে, অভাবের হুলঅলা হিংস্র মশকরা আমাকে নিয়ে নিরবধি মশকরা করছে,তখন ইনকাম ট্যাক্সএর আপিস থেকে দুজন লোক এলেন আমার বাড়িতে। ঘরে ঢুকে ঘরের জিনিসপষেনর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে বললেন, কমপ্লেইন এসেছে, আপনার বাড়িতে নাকি দামি ফার্নিচার আছে। আমরা তদন্ত করতে এসেছি।
আমি যে অকারণে অপদস্থ হচ্ছি, অপমানিত হচ্ছি, আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে আমাকে যে পাঁকে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে, আমি বুঝি। এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার যে শক্তি আর সাহস ছিল আমার, সেটি টেনে ছিঁড়ে টুকরো করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে মানুষ। আমি আমার মাটিতে শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চাইছি, আমাকে ধাককা দিয়ে গভীর খাদে ফেলার ষড়যন্ত্র চলছে। খাদে পড়ে যেন আমি মরি অথবা যদি না মরি আমি যেন কেঁচোর মতো পড়ে থাকি, আর সব কেঁচোর সঙ্গে কেঁচোর জীবন যাপন করি। আমি মুঠোবন্ধ করি দুই হাত। আমার শেষ শক্তিটুকু কেড়ে নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠছে লোকে। আমার অক্ষমতার জন্য আমার রাগ হয়। লজ্জায় ঘৃণায় হতাশায় আমি কুঁকড়ে থাকি। আমার শক্তি সাহস সব উবে যেতে থাকে। মনে হতে থাকে আমি কোনও গর্তের মধ্যে পড়ে গেছি। গর্তে আর সব কেঁচোর সঙ্গে কেঁচোর জীবন যাপন করছি।
কেঁচো তার গর্ত থেকে শুনতে পাচ্ছে বাইরের চিৎকার, ফাঁসি চাই, দিতে হবে।
৩. অতলে অন্তরীণ – ০১
চার, জুন। শনিবার
ফোন এল। একটি কণ্ঠস্বর। কণ্ঠস্বরটি অচেনা।
–আপনার নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট হয়েছে। আপনি বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে।
–আপনি কে বলছেন?
–আমাকে আপনি চিনবেন না।
–নাম বলেন।
–আমার নাম শহিদ। আমি আপনার শুভাকাঙ্খী। আপনার বাড়িতে পুলিশ যাচ্ছে, আপনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। দেরি করবেন না।
কি কারণে হুলিয়া জারি এসবের কিছুই না বলে ফোন রেখে দিল লোকটি। শহিদ নামের কোনও লোকের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। ভাবি, কী কারণ থাকতে পারে এই ফোনের! লোকটি যে ই হোক, লোকটি চাইছে আমি যেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। কোনও ষড়যন্ত্র এর পেছনে লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই। ভাবতে ভাবতে আমি বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে থাকি সামনের রাস্তায় কোথাও কেউ সন্দেহজনক দাঁড়িয়ে আছে কি না। সম্ভবত আশে পাশের কোথাও থেকে লোকটি ফোনটি করেছে, আমি বেরিয়ে গেলে সে তার দলের লোক নিয়ে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কৌশলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে আমাকে মেরে ফেলার ফন্দি এঁটেছে লোক। বাইরে বেরোবার দরজা দুটো একবার দেখে নিই খিল আঁটা আছে কি না। কদিন আগে একটি ফোন এসেছিল এরকম, সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সোজা বলল, আপনার বাড়িতে পুলিশ আসছে। কেন পুলিশ আসছে, কি করতে আসছে কিছুই জানায়নি সেই সাংবাদিক। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় বসে ছিলাম। কিছুক্ষণ বাদে যাদুকর জুয়েল আইচ ফোন করলে পুলিশ আসছে এই খবরটি দিই। জুয়েল আইচ তক্ষুনি ভীত উত্তেজিত স্বরে বললেন, তসলিমা আপনি এক্ষুনি বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে।
–কোথায় যাবো এ সময়?
–কোথাও কারও বাড়িতে চলে যান। আপনি বুঝতে পাচ্ছেন না, কি ভয়ংকর কাণ্ড যে হয়ে যেতে পারে। পুলিশের ওপর কোনও বিশ্বাস নেই।
–এ সময়ে কার বাড়িতে যাবো! রাত হয়ে গেছে..। মিনমিন করি।
–রাত হয়েছে তাতে কি! আশে পাশের ফ্ল্যাটে কোথাও চলে যান।
–কাউকে তো চিনি না।
–আমার এক চেনা লোক আছে দু নম্বর বিল্ডিংএ। আমি তাকে ফোন করে বলে দিচ্ছি। আপাতত তার বাড়িতে চলে যান।
–কিন্তু গিয়েই বা কি লাভ। ফিরে তো আসতেই হবে নিজের বাড়িতে। কারও বাড়িতে লুকিয়ে থেকে কি আর অ্যারেস্ট এড়ানো যাবে। পুলিশ আজ না হোক কাল আমাকে খুঁজে পাবেই। তার চেয়ে যেখানে আছি সেখানেই থাকা ভাল।
জুয়েল আইচ আরও কয়েকবার আমাকে বাড়ি ছাড়ার জন্য অনুরোধ করে ফোন রাখলেন দু নম্বরের চেনা লোককে ফোন করতে। আমি যাইনি বাড়ি ছেড়ে। পুলিশও আসেনি আমার বাড়িতে।
এ ধরনের কোনও ফোনের খবরকে বিশ্বাস করার কোনও মানে হয় না। এটি নেহাত ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়। ফোনে আমাকে হুমকি দেওয়া হয়, গলা কেটে রাস্তায় ফেলে রাখবে, মুণ্ডু উড়িয়ে দেবে, কিন্তু বলাই সার, হাতে নাতে আততায়ীরা আমাকে কখনও পায়নি। এবার বোধহয় এই ফন্দিই এঁটেছে, পুলিশ আসছে বলে ভয় দেখিয়ে বাড়ির বার করবে, আর সঙ্গে সঙ্গেই খপ করে ধরে ফেলে গলাটি আল্লাহু আকবর বলে কেটে সওয়াব কামাবে। চলে যাই আমার লেখার ঘরে, যে লেখাটি লিখছিলাম লিখতে থাকি। এরপর আধঘন্টা পর আবার ফোন। এবারের লোকটিও অচেনা। এবারের লোকটিও বলল, আমাকে আপনি চিনবেন না।