জিল মুসলিম বলতে মৌলবাদী বোঝে। ক্রিশ্চান মৌলবাদীদের ও ক্রিশ্চান বলে। ক্রিশ্চান শব্দটি উচ্চারণের সময় ওর নাক কুঁচকে ওঠে। মুসলিম শব্দটি ভয়ংকর একটি শব্দ, ওর উচ্চারণে আমি তা অনুমান করি।
রেস্তোরাঁয় চেয়ার পেতে শুয়ে আর কতক্ষণ থাকা যায়! উঠে হাঁটাহাঁটি করে সময় কাটাতে থাকি। বিমান বন্দরের জানালায় দাঁড়িয়ে আমরা যখন দেখছিলাম বিমান উড়ছে, নামছে, সৌদিয়া, পিআইএ, বাংলাদেশ বিমান, জিল মন্তব্য করল, দেখেছো সব বিমানগুলোয় সবুজ রং!
তাতে কি?
সবুজ হচ্ছে ইসলামের প্রতীক। সব মুসলিম দেশের পতাকাতেই সবুজ রং থাকে।
আমি তো জানি সবুজ হচ্ছে তারুণ্যের রং। সবুজ হচ্ছে প্রকৃতির রং।
তুমি দেখো, সব মুসলিম দেশেরই পতাকায় সবুজ আছে। কিছু না কিছু সবুজ আছেই।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না। ঠিক বলনি। তুরস্কের পতাকায় নেই।
জিল মাথা চুলকোয়। এটি তার মাথায় ছিল না।
তুরস্ক ছাড়া সব মুসলিম দেশের পতাকায় সবুজ আছে।
খানিকক্ষণ ভেবে বলি, মালোয়েশিয়ায় নেই, তিউনেশিয়ায় নেই। কাতারের পতাকায় নেই।
অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে জিল বলে, গুনে দেখবে বেশির ভাগ দেশগুলোতেই আছে।
অনেক অমুসলিম দেশের পতাকায় সবুজে ভর্তি। ব্রাজিল। ভারত। বুলগেরিয়া। আয়ারল্যাণ্ড। ইতালি। মেক্সিকো। দক্ষিণ আফ্রিকা। আমি নিশ্চিত, আরও অনেক দেশে আছে।
হ্যাঁ থাকতে পারে। কিন্তু মুসলিম দেশের পতাকায় বেশি।
বাংলাদেশের পতাকার সবুজের ব্যাখ্যাটি করে দিলাম, বাংলাদেশ ইসলামিক দেশ নয়। এখনও দেশটির নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। পতাকার সবুজ হচ্ছে আমাদের সবুজ প্রকৃতি।
বাংলাদেশ ছাড়ার আগে জিল সাংবাদিকদের সঙ্গে তার অভিজ্ঞতার কথা বলে। বলে যে অনেক সাংবাদিকের সঙ্গেই তার কথা হয়েছে। আমার সম্পর্কে ওদের সে জিজ্ঞেস করেছে। ওরা অদ্ভুত করে নাকি হেসেছে। বলেছে, ও তো পুরুষ বিদ্বেষী। ও যে রকম নারী স্বাধীনতার কথা বলে, সেটি এ দেশের জন্য খাটে না। জিল আমাকে জিজ্ঞেস করে, সরল জিজ্ঞাসা, সাংবাদিকদের ভ্রূ কুঞ্চন হয় কেন আমার নাম শুনলে? জিল ওদের ভ্রূ কুঞ্চন দেখে বেশ আহত হয়েছে। কী জানি, মনে মনে ভাবছে বোধহয় যে আমাকে এতটা সম্মান জানাতে প্যারিস অবদি নিয়ে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। আমি সংকোচে চোখ ফিরিয়ে নিই। জিলের মুখখানার দিকে তাকিয়ে আমার বোঝা হয় না কোনও অনুশোচনা হচ্ছে কি না তার। বোধহয় হচ্ছে, বোধহয় হচ্ছে না। আমি এই হচ্ছে আর হচ্ছে নার মাঝখানে দুলতে থাকি একা একা। এখানকার সাংবাদিকদের চরিত্র আমি বেশ জানি, তারা কি বলল না বলল তা নিয়ে আমি মোটেও মাথা ঘামাই না। জিলের জন্য আমার মায়া হতে থাকে। সে কষ্ট পাক, চাই না।
ব্যাংককে পৌঁছে দেখি আমাদের ন কি দশ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে প্যারিসের বিমান ধরার জন্য। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বিমান বন্দরে দুটো ঘর নেয় জিল। জিল দুটো ঘর নেয় কেন? ছ ঘন্টায় একটি ঘর চল্লিশ ডলার করে। এত টাকা খরচা করার কোনও মানে নেই। একটি ঘরেই আছে দুটো বিছানা। এতেই তো দুজনের চলত। কি জানি এ বোধহয় সভ্য দেশের বিশেষত্ব। ঢাকা বিমান বন্দরে এক শাদা লোককে দেখিয়ে জিলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, লোকটি কি ফরাসি? জিল এক পলক দেখেই সোজা বলে দিল, না।
–না বললে কেন? কি করে বুঝলে যে লোকটি ফরাসি নয়? ফরাসিদের চেহারায় কি বিশেষ কোনও কিছু আছে?
নিশ্চয়ই, বলে রেস্তোরাঁয় কয়েকটি শাদা লোকের দিকে তাকিয়ে ফট করে একটিকে দেখিয়ে বলে দিল, ওই লোকটি ফরাসি।
তাই বুঝি!
ফিরে ফিরে তাকিয়ে কিছু একটা বিশেষত্ব খুঁজছিলাম চেহারায়, আচার, আচরণে। আছে কি? হুঁ, তা আছে বটে কিছু।
যদিও বিশ্রামের জন্য আমরা ঘর নিয়েছিলাম, ঘুম আমারও হয়নি, জিলেরও হয়নি। আমরা আবার সিদ্ধান্ত নিই, বিমানে ঘুমোবো। বন্দর ঘুরে জিলের জন্য চকলেট কিনেছি। দেখে খুশিতে ফেটে পড়ে। আমি যখন বিশ্রাম নিচ্ছিল!ম ঘরে, তখনই জিল দুজনের পাসপোর্ট আর টিকিট দেখিয়ে দুটো বোর্ডিং কার্ড নিয়ে নিয়েছে। পরে আমাকে মন খারাপ করে বলল, বোর্ডিং কার্ড দিচ্ছে যে মেয়েটি, জিজ্ঞেস করেছে জিলকে, আপনার হাতে বাংলাদেশের পাসপোর্ট কেন? কে এই বাংলাদেশি মেয়ে? একে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছি প্যারিসে। উত্তর শুনে মেয়েটি জিলের দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়েছে। অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছে, একে ওকে ডেকে এনে পাসপোর্ট দেখিয়েছে। এসব শুনে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীদের কী ভীষণ ঘৃণা করে মানুষ! তারা যে কোনও দেশেই অবৈধ ভাবে ঢুকে যেতে পারে, এই আশঙ্কা সবার। আমি সেই দেশেরই মানুষ বেরিয়েছি পৃথিবীর পথে, যার দিকে দেশে দেশে লোকেরা সন্দেহের চোখে তাকাবে। জিল অনেকবার গৌরব করে বলেছে যে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশ ফ্রান্স, সবচেয়ে সুন্দর শহর প্যারিস। সে জার্মানি পছন্দ করে না, কারণ বড় শক্ত শক্ত নিয়ম কানুন ও দেশে, আমেরিকাও তার পছন্দ নয়, কোনও সংস্কৃতি নেই বলে। তবে, জিল, না বললেও বুঝি, যে, বাংলাদেশকে পছন্দ করে না। আর তার অপছন্দের দেশের, প্রচণ্ড গরীব আর সভ্য না হওয়া দেশের মানুষ আমি, আমাকেও নিশ্চয়ই সে পছন্দ করছে না। যদি করে কিছু, সে করুণা।
যখনই বিমানের ভেতর ঢোকার জন্য লোকদের ঠেলাঠেলি ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল, জিল জোরে হেসে উঠে বলে, ‘এরা এমন পাগল হয়ে যাচ্ছে কেন আগে যাওয়ার জন্য, আগে গেলে কি ভাল জায়গায় বসতে পারবে নাকি?’ আমাদের মধ্যেই আগে যাওয়ার কোনও তাড়া ছিল না। আগে গেলেও পরে গেলেও ওই বাহান্নো নম্বর আসনেই বসতে হবে। বিমানের ভেতরে দুজন পাশাপাশি বসে এয়ার হোস্টেসদের দিয়ে যাওয়া কমলার রস পান করছি যখন, জিল বলল, জ্ঞখেয়াল করেছো, এয়ার হোস্টেসদের হাসিগুলো? কি রকম কৃত্রিম হাসি, দেখেছো! যেন রোবটের মুখে হাসি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ রসের গেলাস যখন নিতে এল আরেক এয়ার হোস্টেস, মোটেও না হেসে, জিল আমার কানের কাছে মুখ এনে আস্তে বলে, ‘এ এখনও ট্রেইনি, নকল হাসি রপ্ত করতে শেখেনি।’ ঘুম আমাদের, যা ভেবেছিলাম, হবে, হয়নি। ওরকম বসে বসে কি ঘুমোনো যায়! ঘুমোতে চেষ্টা করে আমারও ঘুম হয়নি, জিলেরও হয়নি। বিমান চলছে কাঠমুণ্ড দিল্লি হয়ে পাকিস্তান আফগানিস্তান পার হয়ে প্যারিসের দিকে। জানালা খুলে দিলে ঝাঁক ঝাঁক আলো এসে সম্ভাষণ জানায়। প্যারিসে যখন নামলো বিমান, চলমান সিঁড়িতে নয়, তুমি হাঁটছো চলন্ত কার্পেটের ওপর দিয়ে, ওতে আর সবার মত হাঁটতে গিয়ে যেহেতু অভ্যস্ত নও, হুমড়ি খেয়ে পড়তে নিয়েছো বেশ কবার। খুব দ্রুত এক দালান থেকে আরেক দালানে পারাপারের জন্য এই যান্ত্রিক ব্যবস্থাটি করেছে ফরাসিরা। কিন্তু বন্যা ঘূর্ণিঝড় আর দারিদ্রপীড়িত দেশের মানুষ এসব যান্ত্রিক জিনিসে কি করে য়চ্ছন্দ হবে! কোনও কারণ নেই। হাঁ হয়ে দেখি বন্দরটি। কি বিশাল! কি বিশাল! বন্দরের নাম শার্ল দ্য গোল। বন্দরটিতে হাজার হাজার মানুষ ছুটছে, মিনিটে মিনিটে বন্দরের উঠোনে বিমান নামছে, উঠোনে বসে থাকা বিমান উড়ে যাচ্ছে। এই আছে, এই নেই। চোখের পলকে দৃশ্যগুলো বদলে যাচ্ছে। ছোটোবেলায় দেখা বায়স্কোপের ছবির মত। এমন দৃশ্য সত্যিকার এই প্রথম দেখছি জীবনে। আমাকে স্বাগতম জানানোর জন্য অপেক্ষা করছিলেন রিপোর্টার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্সের প্রধান রবার্ট মিনার্ড। জিল যাকে হোবিয়া মিনা বলে, অন্তত আমার কানে এরকমই শোনা যায়। রবার্ট মিনার্ড আর হোবিয়া মিনা যে এক ব্যক্তি তা আমার পক্ষে প্রথম বোঝা সম্ভব হয়নি। আমি জানি যে ফরাসি উচ্চারণ ঠিক বানানের মত হয় না। বানানে রিমবাউড হলেও ফরাসি কবির নাম র্যাঁবো, তারপরও শুনি র্যাঁবোও ওরা আমাদের মত উচ্চারণ করে না, কান পাতলে শোনা যাবে খ্যাঁবো। ওদের সম্পর্কে পড়ে আর শুনে জানা এক জিনিস, আর ওদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ওদের সম্পর্কে জানা আরেক জিনিস। হোবিয়া মিনা আমাকে জড়িয়ে ধরে দু গালে চুমু খেলেন। আমি ভীষণ অপ্রস্তুত। অনভ্যাসে কাঠ হয়ে ছিলাম। চকিতে সরিয়েও নিয়েছিলাম মুখ যখন তাঁর মুখ আমার মুখের দিকে এগিয়ে আসছিল। জানতাম ফরাসিরা গালে চুমু খায়, কিন্তু চুমুর সামনে পড়লে মাথার এই জানা বিদ্যেটা চড়ুই পাখির মত উড়ে যায়। হোবিয়া মিনা একটি অক্ষর ইংরেজি জানেন না। আমাদের মধ্যে দোভাষীর কাজ করছে জিল।