হঠাৎ একদিন অভাব এসে আমার দরজায় কড়া নাড়ে। অনেকদিন থেকেই আসছি আসছি করছিল, এবার এসেই পড়ে, ঢুকেই পড়ে চৌহদ্দিতে। না, এমন অভাবকে বরণ করলে চলবে না। আমার অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে, এই খবরটি চাউর হয়ে গেলে আমাকে খুবলে খাওয়ার জন্য শকুনের ভিড় বাড়বে। এতদূর এসে এখন কোনওভাবেই মাথায় হাত দিয়ে আমার বসে গেলে চলবে না। আমাকে সাহায্য করার জন্য কোথাও কোনও প্রাণী অপেক্ষা করে নেই। যত রকম মেরুদণ্ড আছে, সব মেরুদণ্ডই শক্ত করে আমাকে স্রোতের বিপক্ষে বৈঠা বাইতে হবে। কলাম লিখে টাকা রোজগারের একটি পথই এখন অবশিষ্ট। কিন্তু কলাম থেকে আসা টাকা দিয়ে সংসার চলে না। আমার লেখা থাকে বলে পত্রিকা আপিসে হামলা হয়, পত্রিকাগুলোও এখন লেখায় সরকার বা ধর্ম বিষয়ে কোনও মন্তব্য থাকলে ছাপছে না। ভয়। ভয় সরকারি বিজ্ঞাপন হারাবার। সরকারি রোষানলের শিকার হবার ভয়, মৌলবাদীদের হামলার ভয়। ইয়াসমিন আর মিলন সংসারের বাজার খরচ দিচ্ছে, তার ওপর ভালবাসার জন্য ওদের খরচ আছে। আমার টেলিফোনের বিল বাকি, বিল বাকি বিদ্যুৎএর। প্যারিস ছাড়ার পর ফরাসি প্রকাশক ক্রিশ্চান বেস আমার ঠিকানায় লজ্জা বইটির জন্য অগ্রিম রয়্যালটির চেক পাঠিয়েছিলেন। চেকটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম আমি।
চেক আসে না, কিন্তু ফোন আসে ক্রিশ্চান বেস এর। মাঝে মাঝে ফোন করে ভাল আছি কি না, নিরাপদে আছি কি না, কোনওরকম কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না ইত্যাদি জানতে চান। তাণ্ডবের খবর তো সবখানেই যাচ্ছে। তিনি স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন। টাকা পয়সা নিয়ে কথা বলতে আমার এমনিতে লজ্জা হয়, কিন্তু ক্রিশ্চানকে আমি লজ্জার মাথা খেয়ে একদিন জিজ্ঞেস করেই বসি যে তাঁর যে চেক পাঠানোর কথা ছিল, তা কি তিনি পাঠিয়েছেন? ক্রিশ্চান আকাশ থেকে পড়েন শুনে। –বল কি? আমি তো সেই কবেই তোমার ঠিকানায় রেজিস্ট্রি ডাকে চেক পাঠিয়েছি। সেই চেক তুমি নিশ্চয়ই জমা দিয়েছো তোমার ব্যাংকে। কারণ আমাদের ব্যাংক থেকে সে টাকা অনেক আগেই চলে গেছে।
–অসম্ভব। এ হতে পারে না। আমি কোনও রেজিস্ট্রি ডাকে আসা কোনও চিঠি পাইনি, কোনও চেক পাইনি। কোনও চেকই ব্যাংকে চেক জমা দেবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আমি জোর দিয়ে বলি।
ক্রিশ্চান ব্যাপারটির তদন্ত করবেন বলে ফোন রেখে দেন।
এর কদিন পর আবার ফোন করে বলেন –দেখ, আমি ব্যাংকের ম্যানেজারকে বলেছি আমাকে তোমার চেক এর কপি পাঠাতে। ওরা চেক এক কপি যোগাড় করে আমাকে পাঠিয়েছে। আমার কাছে আছে, চেক এর পেছনে তোমার সই আছে।
আমি বলি, ক্রিশ্চান, আমি কোনও চেক পাইনি। কোনও চেক এর পেছনে আমি সই করিনি।
ক্রিশ্চান বলেন, এ কি করে হবে! তুমি না দাও, তোমার অ্যাকাউণ্টে অন্য কেউ জমা দিয়েছে। তুমি খোঁজ নাও তোমার ব্যাংকে।
আমি কূল কিনারাহীন ভাবনায় ডুবতে থাকি। যে চেক আমার হাতে পৌঁছেনি, সেই চেক আমার অ্যাকাউণ্টে কেউ জমা দিয়েছে। কিন্তু কারও হাতে যদি পড়ে আমার চেক, কি করে সে জানবে কোন ব্যাংকে আমার অ্যাকাউন্ট আছে?
আমি ব্যাংকে খোঁজ নিই। ব্যাংক থেকে জানানো হল, আমার অ্যাকাউণ্টে কেউ কোনও চেক জমা দেয়নি।
তবে কার হাতে চেক পড়েছে? কে রেজেস্ট্রি ডাকের চিঠি রিসিভ করেছে? যদি অন্য কেউ রিসিভ করেই থাকে, তবে চেক ভাঙাবে কি করে, আমার নামের চেক আমার অ্যাকাউন্ট ছাড়া জমা হবে না। যদি আবদুল জলিল নামের কোনও চোর আমার চিঠি চুরি করে, চিঠির ভেতরে একটি চেক ও পেয়ে যায়, তবে চেকটি তো তার কোনও কাজেই লাগবে না।
এর মধ্যে ক্রিশ্চান আমাকে চেকএর কপিটি ফ্যাক্স করে পাঠান। যেহেতু আমার নিজের ফ্যাক্স মেশিন নেই, ইয়াসমিনের আপিসের ফ্যাক্স নম্বর দিয়েছিলাম তাঁকে। জরুরি কোনও চিঠি পত্র তিনি ফ্যাক্সে পাঠাবেন বলেছেন। চেক পেলাম বটে। তবে এ সত্যিকারের চেক নয়, আসল চেকটির ফটোকপির ফ্যাক্সকপি। চেক এর পেছনে বাংলায় তসলিমা নাসরিন লেখা। লেখা বটে, কিন্তু আমার হাতের লেখা নয়। এটি সই বটে, কিন্তু আমার সই নয়।
ভাবনার জলে ডোবা আমি পাশের অ্যাপার্টমেণ্টের দরজায় কড়া নাড়ি। অ্যাপার্টমেন্টটি একজন ব্যাংকারের। তাঁর কাছেই সাহায্য চাই চেক এর জট খোলার। তাঁকে সব বলি, চেকটি দেখাই। তিনি শান্ত কণ্ঠে বললেন, খুব সোজা ব্যাপার। যে আপনার চেক পেয়েছে, সে আপনার নাম দিয়ে যে কোনও ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে নিয়েছে।
— কিন্তু সে কি করে প্রমাণ করবে সে তসলিমা নাসরিন?
–এটি তো আরও সোজা, এই নামের একটি আইডি করে নেবে।
–যদি কোনও পুরুষ এটি পায়? তসলিমা নামের আই ডি কি করে করবে?
এর মত সহজ জিনিস আর হয় না। লোকটির বউ কিংবা বোনের ছবি দিয়ে নাম তসলিমা নাসরিন বলে একটি মিথ্যে আইডি করে নিল। কে এখানে খোঁজ নিচ্ছে কার আসল নাম কী! আর যদি সিঙ্গাপুরে হয়..
সিঙ্গাপুরে?
হ্যাঁ ওখানে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল দল আছে, এদের কাজই ডাকে পাঠানো চেক চুরি করা। ওখানে বা অন্য কোনও দেশে চেক ভাঙালে তসলিমা নামটি যে কোনও মেয়ের নাম, তাও তো বুঝবে না।
আমি আঁতকে উঠছি এসব শুনে। এত জটিল কথা ব্যাংকার এমন ভাবে বলছেন, যেন এসবের মত সহজ সরল জিনিস আর হয় না।
‘একটি প্রশ্ন। আমার ঠিকানায় তো চিঠিপত্র আসছে। কোনও চিঠি তো মার যায় না। কিন্তু চেকঅলা চিঠিটি মার গেল কেন?’