০ দেখুন, যেটুকু নিরাপত্তা এখন পাচ্ছি সেটাতো বিদেশি সংস্থাগুলো দিয়েছে বলে। (সাক্ষাৎকার সোনার তরী ১-১৫ ডিসেম্বর ৯৩)
০ ভারতবর্ষ কোনও বাতিল কাগজ ছিল না / যে, তাকে ছিঁড়ে/টুকরো করতে হবে/সাতচল্লিশ শব্দটিকে আমি রাবার দিয়ে মুছে ফেলতে চাই/সাতচল্লিশ নামের কাঁটা আমি গিলতে চাই/উগড়ে দিতে চাই/উদ্ধার করতে চাই আমার পূর্ব পুরুষের অখণ্ড মাটি। ( কলকাতা, দেশ ১২ মার্চ ৯৪ঃ কবিতা – অস্বীকার, তসলিমা নাসরিন)
সম্মানিত ভাইয়েরা,
ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে কারো উপর কোনও জোর জবরদস্তি নেই। তেমনি কেউ ইচ্ছে করলে অন্য দেশের নাগরিকত্বও নিতে পারে। কিন্তু ইসলামের নাম পরিচয় ব্যবহার করে ইসলামের মূল আক্বিদা বিশ্বাসকে অস্বীকার করা, বাংলাদেশের নাগরিকত্বের সুবিধা ভোগ করে এর স্বাধীন মানচিত্রকে অন্যদেশের সাথে মিশিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র বিশ্বের কোনও ধর্মীয়, নাগরিক এবং মানবীয় আইনেই স্বীকৃত নয়। অনেক দেশেই ধর্মীয় মূল্যবোধের অবজ্ঞাকারী শাস্তির জন্য ব্লাসফেমি আইন আছে। কিন্তু আশ্চর্য, বাংলাদেশে অনুরূপ কোনও আইন নেই। অথচ বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, মহান আল্লাহর প্রতি অবিচল ও বিশ্বাস সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রীয় মূলনীতির অন্যতম। এদেশের শতকরা নব্বই ভাগ মানুষ ইসলামের অনুসারী। তসলিমা প্রকাশ্যে এসবকে অশ্লীল, অশিষ্ট ও অনাগরিক ভাষায় পদদলিত করেছে। তার সামগ্রিক কর্মকাণ্ড ইসলাম ও দেশের স্বাধীনতা বিরোধী। অথচ এদেশে এতসব কিছুর পরও তসলিমাকে সরকার আশ্রয় ও শেল্টার দিচ্ছে। তাহলে কি এদেশে আমরা মুসলমান পরিচয় নিয়ে সম্মানের সঙ্গে বসবাস করতে পারবো না? আমরা আমাদের ঈমান ও দেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে আপোস করতে পারি না। রাসুল (সঃ) বলেছেন, তোমরা কোনও অন্যায় দেখলে তৎক্ষণাৎ তা শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ কর। অবস্থা এখন যা দাঁিড়য়েছে তাতে তসলিমাদের এই অন্যায় ঔদ্ধত্যের প্রতিরোধ শুধু মুখের প্রতিবাদ ও নিছক অন্তরের ঘৃণা দিয়ে সম্ভব নয়। সরাসরি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
আসুন! দেশ প্রেমিক ধর্মপ্রাণ ভাইয়েরা! ঈমান ও দেশ রক্ষার জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুলের মর্যাদাকে সর্বোচ্চে বুলন্দ করি এবং আওয়াজ তুলি।
মুরুরতাদদের মৃত্যুদণ্ডের আইন পাস কর
তসলিমার মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে দিয়ে দাও
ই স লা মী ঐ ক্য জো ট
অস্থায়ী কার্যালয়ঃ ৪৪/১ পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০ থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত
২. তাণ্ডব – ০৩
সোনার তরী আর পূর্ণিমা খাঁটি মৌলবাদীদের পত্রিকা। এসব পত্রিকায় আমি কখনও কোনও সাক্ষাৎকার দিইনি। কিন্তু যখন তাদের কোনও প্রয়োজন হয় আমার মুখে কিছু বাক্য বসাবার, তারা নিজ দায়িত্বে সেসব বসিয়ে ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করে। এ দেশের মানুষ মুদ্রিত যে কোনও লেখাকে খুব বিশ্বাস করে। এই বিশ্বাসটিই ইনকিলাব গোষ্ঠীর মূলধন। মুখে ফেনা তুলে ফেলছে কোনও একটি কথা বলে বলে, কারও কানে ঢোকে না তা, আর যখনই লিখে দিচ্ছে সে কথা, পড়তে গিয়ে লোকের মস্তিষ্কে তা সুরুৎ করে ঢুকে যায়। মস্তিষ্কগুলোই এখন এই গোষ্ঠীর খুব প্রয়োজন। এই জাতির মস্তিষ্কের ওপরের আবরণটি খুব পাতলা, খুব য়চ্ছ, খুব সহজে যে কোনও মাল আবরণ ভেদ করে ভেতরে ঢুকে যায়, গোবর ঢোকালে গোবরও ঢুকে যায়, ধর্ম ঢোকালে ধর্মও। আমার বিবৃতিটিই কেবল ঢোকেনি। আমি যে লিখেছি কোরান সংশোধনের কথা আমি বলিনি, সেটির দিকে কেউ ফিরে তাকাচ্ছে না। অথবা তাকালেও মনে মনে বলছে, তুমি কোরানের সংশোধনের কথা এখন হয়তো না বলতে পারো, তাতে কি! কোরান সম্পর্কে কম বাজে কথা এ যাবৎ বলেছো ! এখন জল ঘোলা করোনি, কিন্তু আগে তো করেছো। ভাল যে বলেনি, তুমি জল ঘোলা না করলেও তোমার বাপ ঘোলা করেছে, বাপ না করলেও তোমার বাপের বাপ করেছে, তাই তোমাকে আমরা চিবিয়ে খাবো।
চিঠি আসছে বিদেশ থেকে। নভেম্বরে নরওয়ের লেখক সম্মেলনে যাবার আমন্ত্রণ, অক্টোবরে ফ্রান্সের বই মেলায়, সুইডেনের লেখক-সংগঠন থেকে আমন্ত্রণ, আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন মাসের জন্য লেখালেখির ওপর বিদ্যে নেওয়ার আমন্ত্রণ, নিউ ইয়র্কে মেরেডিথ ট্যাক্স এর নারীবাদী লেখক সভায় আমন্ত্রণ। আমি নিজেই অবাক হই এমন সামান্য লেখকের জন্য এত বড় সম্মান দেখে। বিদেশি কেউ কেউ আমাকে বলেন, আমাদের আশংকা হয় কবে কখন কে আপনাকে মেরে ফেলে। আপনি বরং অন্য কোনও দেশে চলে যান। বাংলাদেশ আপনার জন্য নিরাপদ নয়। আমি হেসে উড়িয়ে দিই এমন অলক্ষুণে প্রস্তাব। এ দেশ আমার, এ দেশ ছেড়ে আমি অন্য কোথাও চলে যাবো কেন? আমি কি পাগল হয়েছি নাকি যে এমন কথা ভাবব? যতদিন বাঁচি এ দেশেই থাকবো। এ দেশে মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আমি একা লড়াই করছি না। মৌলবাদ-বিরোধী একটি বড় শক্তি এ দেশে আছে, আমরা সবাই মিলে দেশটিকে মৌলবাদ মুক্ত করতে চাইছি, সবাই মিলে দেশটির মঙ্গলের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছি। অন্য দেশে গিয়ে নিরাপদে জীবন যাপন করার কুৎসিত ভাবনাটি আমার দুঃস্বপ্নের মধ্যেও মুহূর্তের জন্যও কখনও উঁকি দেয় না।
তাণ্ডবের মধ্যেও জীবন যাপন করছি। শ্বাস নিচ্ছি, ফেলছি। লড়াকু বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি, আলোচনা করছি, প্রেরণা পাচ্ছি, প্রেরণা দিচ্ছি, ভাবছি, লিখছি, পড়ছি, প্রতিবাদ করছি, মিছিলের মুখে পড়ছি, উল্টোদিকে দৌড়োচ্ছি, মিছিল চলে গেলে বেরোচ্ছি, আবার দৌড়োচ্ছি। গন্তব্য অনেক দূর, কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছতেই হবে আমাদের। কিছু একটা করা শক্ত, কিন্তু কিছু একটা করতেই হবে। শামুকের মত গুটিয়ে থাকলে চলবে কেন! শান্ত হও, বাঁধন মানো, ধীরে বল, চিৎকার কোরো না। কিন্তু আমি শান্ত হচ্ছি না, বাঁধন মানছি না, ধীরে বলছি না, আমি চিৎকারই করছি। একটি সম্ভাবনাকে পিষে ফেলা হচ্ছে, সেই সম্ভাবনাকে ছিনিয়ে নিতে চাইছি দুর্বৃত্তদের হাত থেকে। আমি কি একা? না, আমার সঙ্গে অনেকেই আছেন। সরব এবং নীরব অনেকে। কাছের এবং দূরের অনেকে।